ঝুঁকিতে দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্তরা


দেশে শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের অমিক্রন ধরনের জেএন.১ উপধরনটিতে আক্রান্তদের লক্ষণ প্রকাশের তীব্রতা কম হলেও এটি দ্রুত ছড়ায়। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তি, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও যাদের কোমরবিডিটি (একই সঙ্গে থাকা একাধিক রোগ) আছে, তাদের জন্য বড় ঝুঁকির কারণ। এজন্য সব শ্রেণিপেশার মানুষের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সাবধনতা অবলম্বন করতে হবে। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৪ জনের দেহে করোনা শনাক্তসহ একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় রোগী শনাক্তের হার ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধিসহ জেএন.১ উপধরন চোখ রাঙ্গালেও রোগটি প্রতিরোধে কেউই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এমন বাস্তবতায় জেএন.১ উপধরনটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন উপধরনটিকে ‘ভেরিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা এর দিকে নজর রাখার মতো ধরন বলেছে। যেহেতু এটি অতি দ্রুত ছড়ায়, ভীতিটা সেখানেই। তাছাড়া যখন কোনো রোগে সংক্রমণ বেশি হয়, তখন স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর প্রভাব পড়ে। রোগী বেশি হলে হাসপাতালগুলোতে চাপ সৃষ্টি হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিঘ্ন ঘটে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে, রোগ যাতে বেশি না ছড়ায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। বলা হচ্ছে জেএন.১ এর ঝুঁকি কম থাকলেও রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে ফাঁকি দেওয়ায় অনেক বেশি কার্যকর। এ কারণে এর সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি হেলাফেলা করা যাবে না। নতুন উপধরনটির বৈশিষ্ট্য, ছড়িয়ে পরার শঙ্কার দিক এবং প্রতিরোধের ক্ষেত্রে টিকার কার্যকারিতা কতটুকু সে ব্যাপারে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ভাইরোলজিস্ট, চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যবিদদের পরামর্শ নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। আইইডিসিআরকে ভাইরাসের জিনগত নকশা (জেনোম সিকোয়েন্সিং) উন্মোচনের কাজ বাড়াতে হবে।ইমেরিটাস অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘জেএন.১ উপধরনটি দ্রুত ছড়ালেও আক্রান্তদের শরীরে উপসর্গ অপেক্ষাকৃত কম দেখা দেয়। এখনো কারও মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে একেবারে হেলাফেলা করার উপায় নেই। বিশেষ করে যাদের কোমরবিডিটি আছে, অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন। যেমন : উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট, কিডনি, লিভার ও স্ট্রোকের রোগী। যারা ক্যানসারের কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। এছাড়া গর্ভবতী নারী, শিশু ও বয়স্করা বেশি ঝুঁকিতে আছেন। এজন্য সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি আবার জোরদার করা দরকার। হাত ধোয়ার অভ্যাস যেন আমরা ভুলে না যাই। মাস্ক পরা, মিছিল মিটিং পরিহার করা উচিত। না হলে যে কোনো সমসয় দ্রুত হারে বাড়তে পারে।’রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘সাধারণ সর্দিকাশির ক্ষেত্রে যেমন উপসর্গ হয় জেএন.১ আক্রান্তদের ক্ষেত্রেও এমনটা হচ্ছে। এর বাইরে আক্রান্তদের জটিল সমস্যা দেখা যায়নি। তার পরও সবাইকে সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সুবিধা হলো যারা আগে করোনা টিকা নিয়েছেন তাদের শরীরে জেএন.১ এর বিরুদ্ধে কাজ করে। টিকা নেওয়ার পরও কেউ আক্রান্ত হলে ট্রান্সমিশন বা সিভিয়ারিটি কম থাকে। আমরা যেসব নমুনা পাচ্ছি সেগুলোর জেনোম সিকোয়েন্সিং করছি। ইতোমধ্যে নমুনা পরীক্ষা করে পাঁচজনের নমুনায় জেএন.১ শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই এবং ঢাকার বাইরেও রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাই নিয়ম মেনে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। টিকা নিতে হবে। না হলে উপধরনটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।’স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মাদ খুরশীদ আলম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য তুলে ধরে বলেন, ‘জেনোম সিকোয়েন্সিং করে যে নতুন উপধরন পাওয়া গেছে সেটির ফ্যাটালিটি (উর্বরতা) কম। আক্রান্তদের শারীরিক পরিস্থিতি খুব খারাপ হওয়ার প্রবণতাও কম। এটা দ্রুত ছড়ায় বলে অধিদপ্তর করোনা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। সব ধরনের বন্দরে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, নতুন উপধরনটি প্রতিরোধে করোনার টিকাগুলো কার্যকর। আমাদের কাছে ৭০ লাখের মতো টিকা মজুদ আছে। গ্যাভির কাছে আরও আড়াই কোটি টিকা চেয়েছি। সেগুলো মার্চের দিকে দেশে আসবে। কেউ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ নিতে চাইলে এখনো তারা টিকা নিতে পারবেন। এ ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৪ ও ২০২৫ সালে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে চতুর্থ ডোজ হিসাবে এসব টিকা দেওয়া হবে। সবার আগে জনবহুল অঞ্চলে মাস্ক পরা, কাশি বা হাঁচির সময় লাক মুখ ঢেকে রাখা, উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা করানো এবং সংক্রমিত হলে বাড়িতে থাকতে হবে।আরও ৩৪ জনের করোনা শনাক্ত, একজনের মৃত্যু : শনিবার সকাল থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৪৮০ জনের। গত এক দিনে নতুন করে শনাক্ত হয়েছে ৩৪ জন। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৭৫৮ জনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও বাড়িতে উপসর্গবিহীন রোগীসহ গত ২৪ ঘণ্টায় ১৮ জন সুস্থ হয়েছেন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ২০ লাখ ১৪ হাজার ১৭১ জন।