রাজপথে পরিকল্পিত নৈরাজ্য


অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ব্যাটারিচালিত অটো-রিকশার গ্যারেজগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার দাবি স্থানীয়দের :: গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীলরা ঠিকমতো কাজ করছেন কিনা তা নিয়ে যানজটে ভোগান্তিতে পড়া মানুষের মধ্যে সন্দেহ : সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় মানুষ দোকানি পথচারীরা সিএনজি বাসের চালক হেলপাররাও রিকশাচালকদের ধাওয়া দেয় স্টাফ রিপোর্টার হরিসাধন দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘একই অঙ্গে এত রূপ’ সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৫ সালে। প্রায় ৬০ বছর পর ভারতের নরেন্দ্র মোদি প্রযোজিত শেখ হাসিনা পরিচালিত ‘একই অঙ্গে এত রূপ’-এর আবির্ভাব ঘটছে বাংলাদেশে। গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দিল্লিতে বসে মাদার অব মাফিয়া হাসিনা বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘একের পর এক রূপ’ ধারণ করে আবিভর্‚ত হচ্ছেন। উদ্দেশ্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণœ করা। কখনো টেলিফোনে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের নির্দেশনা দিচ্ছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করছেন, কখনো ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। বাংলাদেশের জনগণের উপর প্রতিশোধ নিতেই হাসিনা যেন মরিয়া হয়ে উঠেছেন।১৫ বছর ধরে পোষ্য অলিগার্কদের ব্যবহার করে পলাতক হাসিনা ঢাকার রাজপথে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। বহুরূপী ডাইনির মতো কখনো গার্মেন্টসে, কখনো পাহাড়ে, কখনো প্রশাসনের কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া, কখনো আনসারদের দিয়ে, কখনো সংখ্যালঘু ইস্যু তুলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। সর্বশেষ হাসিনা পরিচালিত ‘পরিকল্পিত নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা’ সিনেমা হচ্ছেÑ রাজপথে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের অবরোধে নামানো। লাঠি হাতে গতকালও ঢাকার কয়েকটি সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছিল ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। হাসিনার পোষ্য ব্যাটারিচালিত অটো-রিকশার গ্যারেজ মালিকরাই মূলত রিকশাচালকদের নামিয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যবসায়ী ও স্থানীয় পর্যায়ের কিছু নেতা পর্দার আড়ালে থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলনে অর্থের জোগান দিচ্ছে। রামপুরায় রাস্তা অবরোধে নেমেছিলেন এমন দু’জন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক জানান, তারা ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ হলে পেডেলচালিত রিকশা চালাবেন। কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ হলে গ্যারেজ মালিকরা বিপুল অংকের টাকার ক্ষতির মুখে পড়বেন। সে কারণে গ্যারেজ মালকরা হাজার টাকা করে দিয়ে তাদের রাস্তা অবরোধে নামিয়েছেন।গতকাল রাস্তা অবরোধ করা ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। এ সময় সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভুক্তোভোগী স্থানীয় জনতাও ছিলেন। অবরোধকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলেও কিন্তু ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন একের পর এক এমন ঘটনা কেন ঘটছে? সবাই জানেÑ এখনো পুলিশ প্রশাসন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে পুরোপুরি সক্রিয় হয়নি। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না? গোয়েন্দা সাংস্থাগুলো আগে এমন ঘটনার খবর জানালে তো সরকার আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। নাকি সর্ষের ভেতরেই ভ‚ত!১৯ নভেম্বর বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাইকোর্ট বেঞ্চ ঢাকা মহানগর এলাকায় তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, আইজিপি, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের আদালতের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। হাইকোর্টের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে রাজপথ, রেলপথ অবরোধ করে নৈরাজ্যের চেষ্টা করছে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। মূলত রিকশাচালকদের পেছনে টাকা খরচ করছে গ্যারেজ মালিকরা। অনুসন্ধান করে জানা গেছে, রাজধানীর খিলগাঁও, মাÐা, বাসাবো, মানিকনগর, রামপুরা, বাড্ডা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, সবুজবাগ, শ্যামপুর, ডেমরা, মোহাম্মদপুর, বছিলা, উত্তরা, ভাটারা, দক্ষিণখান, উত্তরখান, ময়নারটেক, মিরপুর, পল্লবী এলাকায় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ গড়ে উঠেছে। বেশির ভাগ গ্যারেজ অলিগলির ভেতরে টিনশেড ঘরে তৈরি করা হয়। এসব গ্যারেজে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা ১০ থেকে ১২ লাখ। এসব গ্যারেজের বেশির ভাগই বিগত আওয়ামী লীগ রেজিমে গড়ে উঠেছে। গ্যারেজের মালিকদের বেশির ভাগই স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে অবৈধভাবে ব্যাটারিচালিত অটো-রিকশার ব্যবসা করছে। দুই সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স বাগিয়ে নিয়েছেন রাজনৈতিক পরিচয়ে। এমনকি শ্রমিক লীগ, যুবলীগ নামেও ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। আগে এসব অটো-রিকশা রাজধানীর আশপাশের পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে চলাচল করলেও কয়েক মাস থেকে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে চলাচল করছে। হঠাৎ করে মূল সড়কেও এসব রিকশা দাপিয়ে বেড়ানোয় দুর্ঘটনা বাড়ছে এবং সড়কে যানজট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। হাইকোট এসব অবৈধ রিকশা বন্ধের নির্দেশনা দেয়ায় নড়েচড়ে বসেছে অবৈধ অটো-রিকশার ব্যবসায়ীরা। সূত্র জানায়, গ্রাম থেকে আসা রিকশাচালকরা আগে সাধারণ রিকশা চালাত। গ্যারেজের মালিকরা এসব ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা চালাতে বাধ্য করছে। গ্যারেজে নিজেরাই ব্যাটারিচালিত অটো-রিকশা তৈরি করছে এবং ভাড়া খাটাচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশ এসব রিকশা ধরলে ওই গ্যারেজ মালিকরা টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনে। এই অবৈধ অটো-রিকশা চলাচলের সঙ্গে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অসাধু কর্মকর্তারাও জড়িত। তারা অবৈধভাবে অটো-রিকশার লাইসেন্স দিচ্ছেন, মোটা টাকা নিচ্ছেন। আবার ভুয়া লাইন্সেস দিয়েও অটো-রিকশা চলছে।গতকাল সড়ক ও রেলপথ অবরোধে দেখা গেছে, ব্যাটারিচালিত অটো-রিকশা চালকদের হাতে হাতে লাঠি। এই লাঠি ২০০৬ সালের বাইতুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটের আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগ নেতাদের দানবীয় হিং¯্রতা পৈশাচিক কায়দায় রাজপথে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্যের দৃশ্য স্মরণ করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয়Ñ এক বছর আগে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, বর্তমানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী লাঠি বাহিনীর রাজধানীর মোড়ে মোড়ে প্রহরা দেয়ার দৃশ। ভুক্তভোগীদের মতে, এটি পরিষ্কারÑ দিল্লিতে নিরাপদে পালিয়ে থাকা শেখ হাসিনার নির্দেশনায় পরিকল্পিতভাবে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টায় ব্যাটারিচালিত অটো-রিকশাচালকদের মাঠে নামানো হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনযন্ত্র এবং সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে। রাজধানী ঢাকার কোথায় কোথায় ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরি এবং ব্যাটারি চার্জ দেয়া হয় তা কারো অজানা নয়। রাজধানীর গাবতলী, আমিন বাজার, জিঞ্জিরা, কেরানীগঞ্জ, খিলগাঁও, মাÐা, বাসাবো, মানিকনগর, রামপুরা, বাড্ডা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, সবুজবাগ, শ্যামপুর, ডেমরা, মোহাম্মদপুর, বছিলা, উত্তরা, ভাটারা, দক্ষিণখান, উত্তরখান, ময়নারটেক, মিরপুর, পল্লবী এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ব্যাটারিচালিত রিকশার হাজার হাজার গ্যারেজ। ওই সব গ্যারেজে রিকশার ব্যাটারিতে চার্জ দেয়া হচ্ছে। ওই সব গ্যারেজের বেশির ভাগ মালিক আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। হাইকোটের নির্দেশনার পর তারাই রাজপথে নৈরাজ্য সৃষ্টির লক্ষ্যে রিকশাচালকদের রাজপথ, রেলপথ অবরোধে উসকে দিচ্ছে। যাত্রাবাড়ীর মিরহাজিরবাগ এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, ওই এলাকায় কয়েকশ অটোরিকশা গ্যারেজ গড়ে উঠেছে। ওই সব গ্যারেজকে কেন্দ্র করে মাদকের জমজমাট ব্যবসা হচ্ছে এবং চুরি-ছিনতাই বেড়ে গেছে। গ্যারেজগুলোর মালিকদের কাছ থেকে স্থানীয় পুলিশ মাসোয়ারা নেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। অথচ সরকার চাইলে পাড়া-মহল্লায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ব্যাটারিচালিত গ্যারেজগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে পারে।গতকাল রাজধানীর মহাখালী, রামপুরা, যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ, মিরপুর, কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী ও ডেমরা এলাকায় রিকশাচালকরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করায় এসব এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকা যাত্রীদের কয়েকজন সরকারের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ সরকারের গোয়েন্দারা কি ঘুমিয়ে থাকে? ব্যাটারিচালিত অটো-রিকশা গ্যারেজের মালিকরা আন্দোলন করছে এ তথ্য প্রকাশ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগে থেকেই অরাজকতা ঠেকানোর উদ্যোগ নিতে পারত। তখন মানুষকে এভাবে যানজট ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। আওয়ামী লীগের শাসনামলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিএনপি ও জামায়াতের পাঁচ-ছয়জন নেতাকর্মী একত্রিত হতে পারে সে তথ্য পেয়ে আগাম অভিযান চালিয়েছে। এখন সে গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা কি ঘুমিয়ে থাকেন?রাজধানীর মহাখালী, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করা ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সরিয়ে দেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সরেজমিন দেখা যায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে। সেনাবাহিনী সড়ক অবরোধকারীদের ধাওয়া দিলে স্থানীয় মানুষ, দোকানি, পথচারীরা, সিএনজি, বাসের চালক ও হেলপাররাও সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে রিকশাচালকদের ধাওয়া করেন। এতে সড়ক থেকে পালিয়ে বিভিন্ন অলিগলিতে অবস্থান নেয় আন্দোলনরত রিকশাচালকরা।