বেঁচে থাকার পুঁজি দশ টাকার সবজি ‘তরিতরকারি বেইচাই তো খেয়েপরে বেঁচে আছি’


খালা ব্যবসা কেমন চলে? ক্রেতা আসে তো ঠিকঠাক মতো? প্রশ্ন করতেই ঝটপট উত্তর দিলেন সবজি বিক্রেতা সালমা বেগম। বললেন, না বেচতে পারলে সংসার চালাই কী করে? এসব দশ টাকার ভাগা। তরিতরকারি বেইচাই তো খেয়েপরে বেঁচে আছি। তাছাড়া তো বহু আগেই না খেয়ে মরে যেতাম। পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের কুড়িয়ে আনা সবজি বিক্রেতা সালমা বেগম এভাবেই নিজের কষ্টের কথা বলেন। পুরান ঢাকার শ্যামবাজার পাইকারি পাইকারি পণ্যের অন্যতম বৃহৎ বাজার, যেখানে সর্বনিম্ন পাঁচ কেজি হিসেবে পাল্লা কিনতে হয়। এখানে বড় বড় ব্যবসায়ীদের ভিড়ে সালমারা যেন স্থানীয় নিম্নআয়ের মানুষের বড় ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলু, বেগুন, পটল, শসা, মরিচ, পেঁয়াজ, আদা, বরবটি, লেবু, ঢেঁড়স, করলাসহ যাবতীয় সবজির দাম ১০ টাকা। মূলত কুড়িয়ে আনা সবজি ও পাইকারদের কাছে বাতিল হওয়া সবজি অল্প দামে কিনে ভাগা দিয়ে বিক্রি হয় এখানে। আর তাই বাজারটির অধিকাংশ ক্রেতাই নিম্নবিত্ত। কেউ রিকশা চালান, কেউ চালান নৌকা। কেউবা দিনমজুরের কাজ করে দিনশেষে ঢুঁ মারেন এই বাজারে। নিম্ন-মধ্যবিত্তদেরও মাঝে মাঝে দেখা যায় এ বাজারে। বিক্রেতাদের বেশিরভাগই নারী। বিক্রেতা সালমা বেগম বলেন, দুই মেয়ে নিয়ে অভাবের সংসার। জিনিসপত্রের যে পরিমাণ দাম, কীভাবে যে বেঁচে আছি একমাত্র আল্লাহ জানে। সারাদিনে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বিক্রি করতে পারি। এই টাকা দিয়ে টিসিবির লাইন থেকে অল্প দামে চাল-ডাল কিনে খেতে পারতাম; কিন্তু এখন টিসিবির গাড়ি থেকে চাল দেয় না। দুই-তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে খালি হাতে বাড়িতে ফিরতে হয়। নুন জোটে তো ভাত জোটে না। আবার ভাত জোটে তো নুন জোটে না। এভাবেই জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন ১০ টাকার সবজির ভাগাই বেঁচে থাকার একমাত্র পুঁজি। রোকেয়া তার দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে থাকেন নদীর ওপারে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শ্যামবাজারে আসা সবজি ও ফলের ট্রাকগুলোর আশপাশেই ঘুরঘুর করেন তিনি। মালামাল আনা নেওয়ার সময় বস্তা থেকে পড়ে যাওয়া সবজি কুড়ান। সেটা বিক্রি করেই চলে তার সংসার। বিক্রেতা রোকেয়া বললেন, আগে মানুষের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতাম। করোনার সময় সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। পরে এ কাজ শুরু করি। দিনে দুই-তিনশ টাকা বেচতে পারি। এ বাজারের ক্রেতা ইব্রাহিমের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছর পরিবার নিয়ে ঢাকায় বাস করছি। পাশেই একটা জুতার ফ্যাক্টরিতে কাজ করি; যা বেতন পাই তা দিয়ে ঘর ভাড়া আর ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ হয়ে যায়। সংসার ঠিকমতো চলে না। তাই এখান থেকেই শাক-সবজি কিনি। এখানকার বেশিরভাগ সবজি একটু বাসি, ভাঙাচুরা হয়। তবে কম দামে পাই। আরেক বিক্রেতা নাছিমা জানালেন, অনেক মানুষ এখান থেকে বাজার করেন। এটাকে কেউ ১০ টাকার বাজার বলে, কেউ বলে টোকাই বাজার। ভালো সবজি থাকলে মাঝে মধ্যে দাম একটু বেশি থাকে। যেমন বাজারে যে টমেটো ১০০ টাকা, এখানে সেটার ভাগ ১০ টাকা। আবার ভালো চেহারা হলে, সবজিতে দাগ না থাকলে দাম সামান্য বেশিও হয়। তিনি জানান, এখানে যারা বিক্রি করে তাদের অনেকে আবার আড়তেও কাজ করে। তবে এখানে কেজি হিসেবে বিক্রি হয় না। ভাগ হিসেবে বিক্রি হয়; যা নেবেন দশ টাকা। যে সময় যেটার সিজন সবই পাওয়া যায় এখানে। এই ভাগার বাজারে অসংখ্য দিনমজুর, ফেরিওয়ালা, ভিক্ষুকসহ নিম্নবিত্ত ক্রেতা আসে যারা একবারে ৫ কেজির পাল্লা, এক কেজি অথবা আধা কেজি করে কাঁচা সবজি কিনতে পারে না। কারণ যা আয় করে তা দিয়ে হাফ কেজি করে তিনটি সবজি কিনতে গেলেই তারা অন্য পণ্য আর কিনতে পারবে না। কিন্তু ১০ টাকা করে তিনটি বা চারটি সবজি কেনা সহজ। কোনোমতে এক বা দুবেলা কেটে গেলেই হয়। এভাবেই অভাবী মানুষের সংসার চালানোর ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে এই ১০ টাকার সবজির বাজার, কেউ কিনে আবার কেউ বিক্রি করে।