‘ফায়ার অ্যালার্ম’ বাজলেও দোটানায় ক্ষতি বেড়েছে


‘ফায়ার অ্যালার্ম’ বাজলেও দোটানায় ক্ষতি বেড়েছে
রাজধানীর গুলশানের আবাসিক ভবনে আগুন লাগার পরপর ঠিকই \'ফায়ার অ্যালার্ম\' বেজে উঠেছিল। তবে সেই অ্যালার্ম প্রথমদিকে অধিকাংশ বাসিন্দা কানে তোলেননি। তাঁরা ভেবেছিলেন- এমনি এমনি অ্যালার্ম বাজছে। এদিকে আগুনের ঘটনায় গতকাল সোমবার রাজু নামে আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুইয়ে। তিনি ১২ তলার এক ফ্ল্যাটের বাবুর্চি ছিলেন। প্রাণ বাঁচাতে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া সামা রহমান সিনহা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গুরুতর আহত অবস্থায় আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ১১ জন ভর্তি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন আইসিইউতে। তাঁদের অবস্থাও সংকটাপন্ন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির পাঁচ সদস্য গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ভবনটি সুরম্য হলেও নিরাপত্তার ঘাটতি পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস।রোববার সন্ধ্যায় গুলশান-২ এর ১০৪ নম্বর সড়কে ১৩ তলা বাড়ির ছয়তলায় আগুন লাগে। এরপর আগুন ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য তলায়। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনা ও বিমানবাহিনী আগুন নির্বাপণ এবং উদ্ধার কাজে নামে। রাত ১১টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। এর আগে আতঙ্কে এক নারীসহ চারজন ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন।রয়েছে নিরাপত্তার ঘাটতি : পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আপাতদৃষ্টিতে ভবনটি অত্যাধুনিক হলেও নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল। ফায়ার সার্ভিসের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ভবনটির কোনো ফায়ার সেফটি লাইসেন্স ছিল না। তবে ফায়ার সার্ভিস থেকে একটি এনওসি নিয়েছিলেন তারা। যথাযথ পরিদর্শন সাপেক্ষে লাইসেন্স নেওয়ার কথা ছিল। বাসিন্দারা অগ্নিনির্বাপণে প্রশিক্ষিত নন। গুরুত্ব দেননি বাসিন্দারা : আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে \'ফায়ার অ্যালার্ম\' বেজে উঠলেও বাসিন্দাদের অনেকেই ভেবেছিলেন- মাঝেমধ্যে ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। তাই প্রথমে বিষয়টি আমলে নেননি তাঁরা। তবে নিরাপত্তাকর্মীদের চিৎকারে আগুনের বিষয়টি তাঁরা নিশ্চিত হন। এরপরই নিচে নামার চেষ্টা করেন সবাই। ছয়তলার নিচের বাসিন্দারা দ্রুত নেমে পড়েন। তবে ছয়তলার ওপরের অনেকেই আটকা পড়েন।ভবনটির সিকিউরিটি সুপারভাইজার আশরাফুজ্জামান বলেন, বেজমেন্টে কেউ ধূমপান করলে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। এ ছাড়া ধুলাবালুর কাজ করলেও অ্যালার্ম বাজে। এ কারণে বাসিন্দারা এটা ভাবতে পারেন।অনাগত সন্তানের মুখ দেখতে পেলেন না আনোয়ার : গুলশানের অগ্নিকাণ্ডে আতঙ্কিত হয়ে লাফিয়ে পড়ে মারা যান আনোয়ার হোসেন। তিনি ১২ তলায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ফাহিম সিনহার বাসার কর্মচারী ছিলেন। স্ত্রী আমেনা বেগম সন্তানসম্ভবা। থাকেন গ্রামের বাড়ি ভোলায়। আনোয়ারের বোন বিলকিস বেগম বলেন, \'এক সপ্তাহ পর আমেনার সন্তান প্রসবের দিন ধার্য আছে। আনোয়ার অনাগত সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারল না।\' বিলকিস জানান, সন্তান জন্ম নেওয়ার আগে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল আনোয়ারের। এর আগেই আনোয়ার বাড়ি গেল- তবে জীবিত নয়, লাশ হয়ে।স্বজনরা জানান, পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে আনোয়ার তৃতীয়। রোববার গুলশানের ওই ভবনে আগুনের খবর শুনে তাঁরা প্রথমে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। সেখানে জানতে পারেন, আনোয়ার ভবন থেকে লাফ দিয়েছেন। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে তাঁকে। এরপর তাঁরা বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজেন। সর্বশেষ রাত ১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে গিয়ে আনোয়ারের লাশ শনাক্ত করেন তাঁরা। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন স্বজনরা। বাঁচলেন না বাবুর্চি রাজু :আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচতে ১২ তলা থেকে লাফ দিয়েছিলেন মো. রাজু (৩০)। তবে বাঁচতে পারলেন না। গতকাল সোমবার ভোরে গুলশানের জয়নুল হক সিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। রাজুর ভাই মো. সজীব জানান, তাঁর ভাই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ফাহিম সিনহার বাসার বাবুর্চি ছিলেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জে। স্ত্রী ও দুই সন্তান গ্রামের বাড়ি থাকেন।বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত :পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার আ. আহাদ বলেন, আমরা ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। অবশ্য তিনি শর্টসার্কিটের কথা বললেও ফায়ার সার্ভিসের কোনো কর্মকর্তা অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলেননি।তদন্ত কমিটির প্রধান ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আগুনের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। পরিবারের সদস্যদের বাঁচালেন সামা :ভবনটির ১২ তলায় স্ত্রী-সন্তান ও মাকে নিয়ে বাস করেন একমি গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ফাহিম সিনহা। অগ্নিকাণ্ডের সময় তিনি বাসায় ছিলেন না। বাসায় ছিলেন স্ত্রী সামা রহমান সিনহা, মা, দুই সন্তান এবং কাজের লোক। আগুন লাগার পর সামা সিনহা দুই সন্তান ও শাশুড়িকে লিফটে নিচে নামিয়ে দিয়ে আবার ওপরে উঠছিলেন। সাত তলায় যাওয়ার পর বিদ্যুৎ চলে যায়। এ সময় বন্ধ হয়ে যায় লিফট। নিজের চেষ্টায় সামা লিফট থেকে বের হয়ে সাত তলার করিডোরে দাঁড়ান। তাঁর শরীরে আগুন ধরে যায়। এ সময় তিনি লাফ দিয়ে নিচতলায় থাকা সুইমিংপুলে পড়েন।ভবনটির নিরাপত্তাকর্মী রাকিব বলেন, \'আমরা কয়েকজন ম্যাডামকে (সামা) পানি থেকে তুলে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিই।\' রাতেই সামা সিনহাকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। তাঁকে আইসিইউকে রাখা হয়েছে। বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, সামা সিনহার শ্বাসনালি পুড়েছে। লাফ দেওয়ার কারণেও জখম হয়েছেন। ঝুঁকিমুক্ত বলা যাচ্ছে না। ১৮ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।ফাহিম সিনহার ব্যক্তিগত সহকারী ইসমাইল হোসেন জানান, ফাহিমের বাসার গৃহকর্মী রোজিনা আক্তারও অসুস্থ হয়েছেন। তাঁকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ভবনটি নিয়ম মেনেই করা হয়েছে : আগুন লাগা ভবনটি নিয়ম মেনেই করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। গতকাল তিনি ভবনটি পরিদর্শনে যান। এ সময় তিনি বলেন, যে কোনো সময় আগুন লাগতে পারে। এটি দুর্ঘটনা। জরুরি পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাকর্মী ও বাসিন্দারা প্রশিক্ষিত ছিলেন কিনা জানা নেই। বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। তবে আর্থিং লাইন ও ইলেকট্রিক লাইন একই পাইপে উঠেছে। দুই লাইনের মাঝে ফাঁকা থাকে। তিনি আরও বলেন, বাসাবাড়িগুলোতে অগ্নি-মহড়া দেওয়া হয় না। সবাইকে সচেতন হওয়া দরকার।