অন্য আলোয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও পর্যটন দেখা


বেশ কিছুদিন হলো আমেরিকায় এসে বিভিন্ন স্থানে ঘুরেফিরে আমি নানারকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, যার কিছুটা আমার পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। এখানে এসে আমি আমার মেয়ের বাড়িতে উঠেছি। আমার একমাত্র কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। পিএইচডি করার জন্য সে এখানকার টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি লাভ করায় আজ প্রায় দুই বছর হলো এখানে এসে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সংসার পেতেছে। টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়টি আমেরিকার প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একশ বছরের বেশি প্রাচীন এ বিশ্ববিদ্যালয়টি টেক্সাসের একটি শান্ত শহর ‘লাবাক’ সিটিতে অবস্থিত। সারা পৃথিবী থেকে আগত প্রায় পঞ্চাশ হাজার ছাত্রছাত্রীর কলতানে মুখর এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ফিলিপাইন, বাংলাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ইত্যাদি অঞ্চল থেকেও প্রচুর শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ করতে এসেছেন। এ অবস্থায়, আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে প্রায় নব্বই শতাংশ শিক্ষার্থী আমেরিকান হলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এখানকার মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেক আমেরিকান এবং বাকি অর্ধেকই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত। এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করেই ‘লাবাক’ সিটি গড়ে উঠেছে। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষা প্রায় পাঁচগুণ বড় এলাকা বিশিষ্ট এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সুবিধাজনক কোনো স্থানে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য বরাদ্দ পেতে ৩-৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশকেই ক্যাম্পাসের প্রান্তিক এলাকায় গাড়ি পার্ক করে অনেকটা পথ হেঁটে ক্লাসে আসতে হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৩টি কলেজের মাধ্যমে ১৫০টিরও বেশি কোর্সে শিক্ষাদান করা হয় : ‘‘The Texas Tech University hosts 60 research centers and institutes.The University has awarded over 200,000 degrees since 1927, including over 40000 graduates and professional degrees. Texas Tech is classified among \'R1: Doctoral Universities- Very high research University.\' Research projects in the areas of epidemiology, pulsed power, grid computing, classics, nanophotonics, atmospheric sciences and wind energy are among the most prominent at the University.’’ খেলাধুলার ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে : ‘The Texas Tech Red Raiders are charter members of the Big 12 conference and compete in Division 1 for all varsity sports. The red Raiders football team has made 12 conference and compete in Division 1 for all University sports.’ তাছাড়া বাস্কেটবলসহ খেলাধুলার অন্যান্য ক্ষেত্রেও টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয় ডিভিশন ওয়ান টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে জাতীয় পর্যায়ে সাফল্যের পরিচয় প্রদান করে থাকে। এখানে এমন দু-একটি বিষয় উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনামূলক একটি অবস্থান তুলে ধরা। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়সও ১০২ বছর পার হয়েছে। অথচ আজও এখানে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠল না, যেখানে গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ঋদ্ধ হবেন, নতুন কিছু উদ্ভাবন করে দেশ ও জাতিকে উপহার দেবেন, উপকৃত করবেন। কিন্তু সেসব দিকে না গিয়ে এক সময়ের অক্সফোর্ডখ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির নামধারী একশ্রেণির পেটোয়া বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে চলেছে; যখন যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে, সেই দলের লেজুড়বৃত্তি করে টেন্ডারবাজি ইত্যাদি পদ্ধতিতে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছেন। আবার একশ্রেণির শিক্ষকও সেখানে রাজনীতি করে চলেছেন; রাজনীতি করে খাচ্ছেন! অধ্যাপক নামধারী ওইসব শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদান অপেক্ষা রাজনীতি করা বা রাজনীতি করে খাওয়াকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেটিং পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। কারণ, সেখানকার ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে প্রায় সবাই বিদ্যাচর্চা, জ্ঞানচর্চা, গবেষণা অপেক্ষা রাজনৈতিক চর্চাকেই অধিক গুরুত্ব এবং মূল্য দিয়ে থাকেন। খেলাধুলা বা স্পোর্টসের বিষয়টি তো সেখানে আছে বলে মনেই হয় না; থাকলে জাতীয় পর্যায়ে বা লীগ পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ফুটবল টিম অন্তত আমরা দেখতে পেতাম। যদিও এ খাতে বিশ্ববিদ্যালয় বাজেটের একটি বিরাট অংশ ব্যয় করা হয়। এ অবস্থায় উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ, ডক্টরেট, পোস্ট ডক্টোরাল ইত্যাদি ডিগ্রি অর্জনের জন্য আমাদের সন্তানদের টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দূর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ই ভরসা। টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে অল্প করে আরও একটু বলতে গিয়ে বলতে চাই, আমাদের দেশে wind energy তৈরিতে দক্ষ ব্যক্তির প্রয়োজন বিধায় বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে এখানে শিক্ষার্থী পাঠিয়ে wind energy বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা উচিত। কারণ আমেরিকার সবচেয়ে বৃহৎ wind mill museum তথা গবেষণা কেন্দ্রটিও এখানেই অবস্থিত। অতএব সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ তথা সরকার এ বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। ২. বর্তমানে আমি এখান থেকেই টেক্সাসের আশপাশের আরও দু-একটি রাজ্য ঘুরে এসেছি, যার মধ্যে অন্যতম কলোরাডো ও নিউ মেক্সিকো। কলোরাডো গিয়ে দেখি এখনো সেখানে প্রচণ্ড শীত; বাইরে বের হলেই বাতাসের সঙ্গে বয়ে আসা কনকনে ঠান্ডা শরীরকে হিমশীতল করে তোলে। এ অবস্থায় সারা শরীর শীতবস্ত্রে মুড়িয়ে হাত-কান ঢেকে তবেই আমরা কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখেছি। এখানকার একটি দর্শনীয় স্থানের নাম, ‘গার্ডেন অব দ্য গড’; যেখানে লাল লাল পাথরের পাহাড় বা সুউচ্চ অনেক চওড়া দেওয়ালের মতো লাল পাথরের সারি সারি দেওয়াল, গভীর খাদ ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। স্থানটিতে প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় দেখলাম এবং স্থানটি ভালো একটি ট্যুরিজমের হাব হিসাবে গড়ে উঠেছে। কলোরাডো গিয়ে আমরা যে রিসোর্টে উঠেছিলাম, তা ছিল পাহাড়ের পাদদেশে বা পাহাড়ের গায়ে গড়ে তোলা বিরাট এলাকাজুড়ে শখানেক রিসোর্ট ভবনের একটি। এসব রিসোর্ট ভবনের প্রায় চারশটি ডাবল্ বেডেড রুমের অধিকাংশই বুকড্ ছিল। আবার এ রিসোর্টকে কেন্দ্র করে সেখানে একটি গলফ্ কোর্সও গড়ে তোলা হয়েছে; অনেকে দু-চারদিনের অবসরে এসে সেখানে গলফ্ খেলেন; আর রিসোর্ট থেকেই গলফ্ খেলার সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। রিসোর্টটির কথা এখানে উল্লেখ করার বিশেষ কারণ হলো, আমাদের দেশের পার্বত্য এলাকাতেও এমন সুন্দর রিসোর্ট, গলফ্ ক্লাব ইত্যাদি গড়ে তোলা হলে দেশি-বিদেশি অনেকেই সেখানে অবসর সময় কাটাতে যেতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, পর্যটনের ক্ষেত্রে খুঁড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণের ফলে আমাদের অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন ক্ষেত্রটি আজও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারল না। তাছাড়া পর্যটন উন্নয়নে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় বা হয়েছে, তারা পর্যটনের ‘প’ জানেন বলেও মনে হয় না। যুগ যুগ ধরে একশ্রেণির আমলা পর্যটন ক্ষেত্রের চেয়ারে বসে যা করেছেন বা করছেন, তাতে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করাই যায়। কারণ, কক্সবাজারের সৌন্দর্য যে আগের তুলনায় নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, সে বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। ছয় মাস আগে আমি সেখানে গিয়ে দেখি বিচে বসে থাকার মতো পরিবেশও নেই; বিদেশি বা দেশীয় পর্যটকদের যারা পরিচ্ছন্নতা এবং শান্তশিষ্ট পরিবেশ পছন্দ করেন, তারা এক মুহূর্তও সেখানে বসতে চাইবেন না। আর কাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে তো কক্সবাজারকে কংক্রিটের বস্তি বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। আমার মনে হয়, যেসব ব্যক্তিকে এসব কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অচিরেই তারা তাদের ষোলকলা পূর্ণ করে বাদবাকি কাজটুকুও সেরে ফেলবেন। কারণ কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্মিত ফ্ল্যাটগুলোর কয়েকটি ঘুরেফিরে যা দেখলাম, তাতে মনে হলো, দেশের রাস্তাঘাট নির্মাণের ঠিকাদাররা যেভাবে এবড়োখেবড়ো রাস্তা নির্মাণ করে থাকেন, ঠিক একইভাবে কক্সবাজারে নিুমানের ফ্ল্যাট নির্মাণ করে একশ্রেণির মানুষের কাছে তা বিক্রি করা হয়েছে এবং যারা কিনেছেন তাদের কেউ সেগুলো নিজেরা ভোগদখল না করে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন! এ অবস্থায় ফ্ল্যাটগুলো নির্মাণে পর্যটন বিকাশে কোনো ভূমিকা রাখেনি। অথচ একটু ভালো অবস্থানে সুন্দর সুন্দর কিছু ফ্ল্যাট এবং রিসোর্ট করলে ওই শ্রেণির বাড়িভাড়া ব্যবসায়ীরা তা কিনতেন না; অপেক্ষাকৃত উন্নত চিন্তাধারার বা রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্রয় করা সেসব ফ্ল্যাট, রিসোর্ট পর্যটন শিল্পে অগ্রগতি ঘটাত; কিন্তু তা না করে বিভিন্ন প্রাইভেট এলাকার মধ্যে খণ্ড খণ্ড জমিতে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বাড়িভাড়া ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি করা হয়েছে। লেখাটির উপসংহার টেনে বলতে চাই, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিদ্যা অর্জন, জ্ঞান অর্জন, গবেষণাকেন্দ্র ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হলে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে; দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ, কর্মচারী নিয়োগ, হলগুলোয় শিক্ষার্থীদের সিট বণ্টন ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে। অন্যদিকে পর্যটন শিল্পেরও সঠিক বিকাশ ঘটাতে হলে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পারদর্শী ব্যক্তিদের পদায়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব কাজ সব মানুষকে দিয়ে হয় না। ‘এমসিকিউ’ পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করা অথবা বই মুখস্থ করে পাশ করা চাকরিজীবী শ্রেণির মানুষকে দায়িত্ব দিলে কক্সবাজারের মতো পর্যটন কেন্দ্র যেমন আগের তুলনায় খারাপ হয়ে যাবে, তেমনি নতুন কোনো পর্যটন কেন্দ্রও সঠিক এবং সুন্দরভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট