আওয়ামী লীগের মধ্যে একলা চলো নীতি দেখা যাচ্ছে


বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে তাঁরা সাময়িকভাবে পরাজিত করতে পারলেও এখনও পুরোপুরি নির্মূল করতে পারেননি। ১৪ দল তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির যে কোনো অনৈক্য বা বিভেদ আগামী দিনের আদর্শিক লড়াই-সংগ্রামকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। আওয়ামী লীগের মধ্যে এক ধরনের ‘একলা চলো’ নীতি দেখা যাচ্ছে। জোটে নানা সিদ্ধান্ত হলেও কার্যকর হয় না। এসব নিয়ে এখনই আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির শীর্ষ নেতা রাশেদ খান মেনন এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে আগামী দিনের করণীয় এবং বিএনপির আন্দোলন ও জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক অমরেশ রায়। প্রশ্ন : হঠাৎ ১৪ দলের ঐক্য-অনৈক্য নিয়ে কথা উঠছে কেন? উত্তর : হঠাৎ হবে কেন? আমরা তো বহু আগে থেকেই বলছি। ১৪ দলের অভ্যন্তরীণ বৈঠকগুলোতে বলেছি, বাইরেও বলেছি, সংসদেও বলেছি। আমি কেবল একা নই। জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ১৪ দলের অন্য নেতারাও বলেছেন। তবে বলতে পারেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে হয়তো এখন এই বলাটা উচ্চকিত হয়েছে। প্রশ্ন : সম্প্রতি ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে একটিতে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী ১৪ দলের মনোনয়ন নিয়ে হেরে গেলেন, এমনটা কেন হলো? উত্তর : আমাদের প্রার্থী শুধু হারেননি, খুব খারাপভাবেই হেরেছেন। এই প্রার্থীই ২০১৪ সালের নির্বাচনে চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও দলীয় প্রতীক ‘হাতুড়ি’ নিয়ে নির্বাচন করে জিতেছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই প্রার্থীই যখন নৌকা পেলেন, তখন দেখা গেল– আওয়ামী লীগের বন্ধুরা এমন অবস্থার সৃষ্টি করলেন যে, সেখানে বিএনপি বিজয়ী হয়ে গেল। এবারের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের তরফে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের জেলা কমিটিকে এবং ১৪ দলের সমন্বয় কমিটির তরফ থেকে আমির হোসেন আমু চিঠি দিয়ে সবাইকে জোটের প্রার্থী হিসেবে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীকে জেতাতে ভূমিকা রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন আমরা সেভাবে পাইনি। তাছাড়া সাম্প্রদায়িকভাবেও বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগেরই একজন হিন্দু প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হিন্দু ভোটকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। একটা কথাই শুধু বলব– এটা কেবল আমাদের জন্যই অশনিসংকেত নয়, আওয়ামী লীগের জন্যও অশনিসংকেত। প্রশ্ন : উপনির্বাচনে হারার ক্ষোভ থেকেই কি এটা বলছেন? উত্তর : সেটা হবে কেন? বরং এটা বলছি এই কারণে যে, আগামী দিনের পরিস্থিতি সঠিকভাবে উপলব্ধি করে সেটাকে মোকাবিলায় আমরা যেন একসঙ্গে থেকেই কাজ করতে পারি। মনে রাখতে হবে, ১৪ দলের আদর্শিক লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে আমরা সাময়িকভাবে পরাজিত করতে পেরেছি বটে; কিন্তু এখনও পুরোপুরি নির্মূল করতে পারিনি। সেই জায়গায় ১৪ দল তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির মধ্যকার যে কোনো ধরনের বিভেদ বা ভুল বোঝাবুঝি কিন্তু আগামী দিনের চূড়ান্ত লড়াই-সংগ্রামকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং, এখনই আমাদের সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। প্রশ্ন : জোটের মধ্য থেকে এমন প্রকাশ্য বক্তব্য ঐক্যে ফাটল ধরানোর আশঙ্কা তৈরি করছে কিনা? উত্তর : না, আমি সেটা মনে করি না। কারণ আমরা দলগতভাবে মনে করি যে, ১৪ দলের ঐক্য এখনও প্রাসঙ্গিক এবং এটাকে আরও দৃঢ় করাই হচ্ছে এখনকার মূল কাজ। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি, এই ঐক্যকে সাংগঠনিকভাবে আরও কার্যকর জায়গায় নিয়ে যাওয়াটাই অনেক বেশি প্রয়োজন। ১৪ দলের ঐক্যকে আরও সংহত করা এবং কার্যকর করাই আমাদের লক্ষ্য। প্রশ্ন : ১৪ দলের মধ্যে ঐক্য আসলে কতটা রয়েছে? উত্তর : ঐক্য যে পুরোপুরি নেই, সেটা আমি বলব না। বরং এটাই বলব, সাংগঠনিক কাঠামোগত ঐক্যের জায়গাটা এখনও গড়ে ওঠেনি। সেটা হয়তো কেন্দ্রে রয়েছে, কিন্তু জেলা বা উপজেলা অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ে নেই। আর রাজনৈতিকভাবে বলতে গেলে, একটা আদর্শিক ঐক্যের বন্ধন তো আছেই। তবে এই ঐক্যের বন্ধনটাও আবার অনেকটা শিথিল অবস্থায় বিরাজ করছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ তার সরকারকে তো ‘আওয়ামী লীগ সরকার’ বলেই ঘোষণা করেছে। সুতরাং, এখানে ১৪ দলের ঐক্য বা অবস্থানটি খুব প্রান্তিক জায়গায় পৌঁছে গেছে। প্রশ্ন : বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো একসঙ্গে মাঠে থাকলেও ১৪ দলের মধ্যে সেটা দেখা যাচ্ছে না কেন? উত্তর : ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই আওয়ামী লীগের মধ্যে একধরনের ‘একলা চলো’ নীতি দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ হয়তো নিজেরাই নিজেদের যথেষ্ট বলে মনে করছে। সেজন্যই হয়তো তারা বিএনপি-জামায়াত বা সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে এককভাবে মোকাবিলা করার নীতি নিয়েছে। তবে ১৪ দলের সিদ্ধান্ত ছিল, এটাকে জোটগতভাবেই মোকাবিলা করা হবে। কিন্তু এটাই দুর্ভাগ্যের বিষয়, ১৪ দলে বারবার নানা সিদ্ধান্ত হলেও একটাও কার্যকর হয় না। প্রশ্ন : এ থেকে বের হয়ে আসার ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী থাকবে? উত্তর : আমার পরামর্শ তো একটাই। ১৪ দলের বিষয়গুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলাপ করে নিতে হবে। সেটা করলেই তো পারস্পরিক বন্ধনটা আরও দৃঢ় হয়। যেমন– যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ও হেফাজতসহ সাম্প্রদায়িক ইস্যু, পাঠ্যপুস্তককে সাম্প্রদায়িকীকরণের অপচেষ্টা এবং জনজীবনের সংকটগুলো মোকাবিলায় কেবল প্রশাসনিক বা সরকারের ভূমিকা না রেখে জোটগত ভূমিকা রাখাটাও দরকার ছিল। এ ক্ষেত্রে জনগণকে আস্থায় এনে জোটগতভাবে সরকারের সহায়কের ভূমিকা পালন করা যেত। কিন্তু এগুলোকে কেবল এককভাবে কিংবা প্রশাসনিকভাবে হ্যান্ডল করতে গিয়ে পরিস্থিতি আরও নাজুক করে ফেলা হচ্ছে। প্রশ্ন : আগামী নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটগতভাবে অংশগ্রহণ নিয়ে কোনও সংশয় আছে? উত্তর : আমরা তো আশাই করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর দল ঐক্যকে এগিয়ে নেবেন। নির্বাচন তো কেবল কথার ঐক্য নয়। এটা তো মাঠের ঐক্য, ভোটের ঐক্য এবং নির্বাচনের মেশিনারিজের ঐক্য। এগুলো যদি করতে হয়, তাহলে অবশ্যই সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই যেতে হবে। তা নাহলে তো এটা কথার কথাই থেকে যাবে। সে ক্ষেত্রে আসন সমঝোতা হয়তো বা হবে। কিন্তু সেটাতে নির্বাচনী কোনো ঐক্য বলে কিছু থাকবে না। প্রশ্ন : আপনারা তো বলছেন আগামী নির্বাচনে নিজস্ব দলীয় প্রতীক নিয়ে অংশ নেবেন, দলীয় প্রতীক নিয়ে জিতে আসার মতো পরিস্থিতি কি তৈরি করতে পেরেছেন? উত্তর : দেখুন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করব– সেটা কিন্তু আমাদের আজকের সিদ্ধান্ত নয়। ২০১৯ সালেই আমাদের দলীয় কংগ্রেসে এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছি। এখন জেতার মতো পরিস্থিতির প্রশ্ন যদি তোলেন, তাহলে বলতে হয়– আমরা অতীতে ১৯৭৯ এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও তো দলীয় প্রতীকেই জিতেছিলাম। তবে ২০০৮-এ এসে ১৪ দলের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা সময় ও প্রয়োজনের তাগিদে আমরা নৌকা প্রতীক নিয়েছিলাম। কিন্তু, আমাদের পরবর্তীকালের অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়, বরং এটা আমাদের অনেকখানি পিছিয়ে দিয়েছে। যেমন– সংবিধান সংশোধনের সময় বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের দ্বিমত ছিল। সে প্রশ্নে আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি’, কিন্তু দ্বিমতটাকে ভোটে রূপান্তরিত করতে পারিনি। অথবা সংসদে এমন কিছু বিষয় আসে– যেগুলোতে আমাদের কথা বলা প্রয়োজন হয়ে পড়লেও আমরা বলতে পারি না। সেটাতে ৭০ বিধির বাধা রয়েই গেছে। সে কারণে সংসদেও আমরা সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছি না। তাছাড়া, আমাদের সক্ষমতা কতখানি এবং ২০০৮ থেকে এই ১৪ বছরে আমরা কতখানি এগোলাম বা পেছালাম অথবা জনগণের কাছে আমরা কতটুকু যেতে পারছি বা পারছি না– সেটাও তো আমাদের যাচাই ও হিসাব করার প্রয়োজন রয়েছে। এই বিবেচনায় আমরা মনে করি, আমাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করা প্রয়োজন। প্রশ্ন : বিএনপির আন্দোলনকে কীভাবে দেখছেন? উত্তর : বিএনপির আন্দোলনের মূল বিষয় হচ্ছে ক্ষমতা। সেখানে জনগণের প্রশ্নটি পুরোপুরি অনুপস্থিত। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, তাদের একজন নেত্রী দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হয়ে কারাগারে আছেন। আরেকজন দুর্নীতিবাজ হত্যাকারী নেতা দণ্ডিত হয়ে বিদেশে পলাতক আছেন। এই দুইজনের দণ্ড মওকুফ করার জন্যই বিএনপির ক্ষমতার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সুতরাং, এই নেতৃত্বের অধীনে আন্দোলনে দেশের জনগণ খুব একটা সাড়া দেবে– সেটা আমি মনে করি না। প্রশ্ন : আগামী নির্বাচন কতটা অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে মনে করেন? উত্তর : যদি সব দল অংশ নেয়, তাহলে আগামী নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে। সব দল অংশ নিলে সেই নির্বাচনকে অবশ্যই অবাধও হতে হয়। এখন নির্বাচন কমিশন যদি তার সঠিক ভূমিকা পালন করে এবং সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের সব অংশও তাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখে তাহলে অবশ্যই নির্বাচন ভালো হবে। আমরাও সেটাই আশা করব। প্রশ্ন : বিএনপি ও তার মিত্ররা যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না আসে? উত্তর : সেটা করলে তো তারা নিজেরাই নিজেদের অবলুপ্তির পরিণতি ডেকে নিয়ে আসবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনটা হয়তো বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, জাতীয় ক্ষেত্রে হবে না। তারপরও সেই নির্বাচনকে সবাই মেনেও নেবে।