আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন এখন সময়ের দাবি


বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়ণ, সুষ্ঠু নির্বাচন, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব এবং সুস্থধারার রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই আলোচনা হচ্ছে। প্রচলিত ধারার নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তনের দাবিও করছেন অনেকে। বলা হচ্ছে বিরাজমান নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তনের কথা। এ পদ্ধতি ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে, দিনদিন ছড়িয়ে পড়ছে দেশে দেশে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল ও শ্রীলংকায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। এ নিবন্ধে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা করতে চাই। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতামূলক পদ্ধতির। এ পদ্ধতিতে প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় একাধিক প্রার্থীর মধ্যে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পান তিনিই নির্বাচিত হন; এক ভোট বেশি পেলেও তিনিই হন ওই এলাকার জনপ্রতিনিধি। এক্ষেত্রে একদিকে যেমন শতকরা হারে মোট ভোটারের নগণ্যসংখ্যক ভোট পেয়েও জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকে, তেমনই জাতীয়ভাবে বেশি ভোট পেয়েও কোনো দল সরকার গঠনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০.৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করা গেলেও এর চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে বিরোধী দলে বসতে হয়েছে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতিতে সরাসরি কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থী জয়ী হয় না, জয়ী হয় দল। যে দল শতকরা যত ভাগ ভোট পায়, শতকরা ততভাগ আসনও সেই দল পায়। আমাদের দেশের জাতীয় সংসদে যেহেতু ৩০০ আসন (প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনে); এক্ষেত্রে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনে কোনো দল যদি ০.৩৩ শতাংশ ভোটও পায়, তবে তারা একটি আসন পাবে। নির্বাচনের আগেই প্রতিটি দলকেই প্রার্থী তালিকা নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়াসহ প্রকাশ করতে হয়। যে দল আনুপাতিক হারে যতটি আসন পাবে, তালিকার প্রথম থেকে শেষ, এ ধারাবাহিকতায় তা পূরণ হবে। উল্লেখ্য, কোনো কোনো দেশে First Past The Post-FPTP এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন পদ্ধতির সমন্বয়ে মিশ্র পদ্ধতির নির্বাচনব্যবস্থা চালু রয়েছে, যেমন নেপাল। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতির ইতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে-প্রথমত, এ পদ্ধতির নির্বাচনে প্রকৃত অর্থেই গণরায় প্রতিফলিত হয়। এখানে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠের (৫০ শতাংশের অধিক) ভোট পায়, তারাই সরকার গঠন করে; দ্বিতীয়ত, দলভিত্তিক জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় বলে নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যক্তির বদলে দলীয় নীতি-আদর্শ ও নির্বাচনি ইশতেহার বেশি গুরুত্ব পায়। সংগত কারণেই প্রতিটি দলকে দলীয় নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করতে হয়। ফলে ক্রমেই সুস্থ রাজনীতি চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি হয়; তৃতীয়ত, কোনো প্রার্থীর জন্য নির্দিষ্ট নির্বাচনি এলাকা না থাকায় এলাকাভিত্তিকভাবে মরিয়া হয়ে জয়ের প্রচেষ্টা যেমন হ্রাস পায়, তেমনই নির্বাচনি প্রচারণায় আচরণবিধি ভঙ্গ, সহিংসতা ও টাকার খেলার সম্ভাবনাও হ্রাস পায়; চতুর্থত, কোনো সংসদ সদস্যের জন্য নির্দিষ্ট নির্বাচনি এলাকা না থাকায়, স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সংসদ-সদস্যদের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা হ্রাস পায় এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় সংসদ-সদস্যরা দেশের আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণসহ মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে মনোনিবেশ করতে পারে; পঞ্চমত, দ্বিদলীয় ব্যবস্থা ভেঙে যায় এবং ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের মূল নেতৃত্ব সংসদে আসার সুযোগ পায়। ফলে গুণগত দিক থেকে সংসদের কার্যকারিতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়; ষষ্ঠত, এ পদ্ধতির প্রবর্তন হলে ‘ভোট পচে যাওয়া’র ধারণা থেকে ‘মন্দের ভালো’কে ভোট প্রদানের প্রবণতা থেকে ভোটাররা বেরিয়ে আসতে পারে এবং আদর্শভিত্তিক ছোট দলগুলোর ভোটপ্রাপ্তির শতকরা হার বৃদ্ধি পায়। সপ্তমত, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। ধারণা করা হয়, আমাদের দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের কারোর জনসমর্থনই ৩০ শতাংশের কম নয়। তাই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন হলে, কেউই ৯০টির কম আসন পাবে না; অষ্টমত, প্রতিটি রাজনৈতিক দল থেকে বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্টসংখ্যক (কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ) নারীকে মনোনয়ন প্রদানের বিধান করা হলে নারীদের জন্য পৃথকভাবে আসন সংরক্ষণের কোনো প্রয়োজন হবে না। এক্ষেত্রে প্রতিটি দলের মনোনীত প্রার্থী তালিকা হবে ‘একজন নারীর পর দুজন পুরুষ বা দুজন পুরুষের পর একজন নারী’ এ ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে; নবনির্মিত, কোয়ালিশন সরকার গড়ার সম্ভাবনা থাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় ও সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ধারণা করা হয়, একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে কোনো দলেরই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে সরকার গঠনের জন্য একমাত্র উপায় হতে পারে কোয়ালিশন সরকার বা অন্যদলের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনের নেতিবাচক যে দিকগুলো আলোচনায় আসে, তা হলো-প্রথমত, কোয়ালিশন সরকার গঠনের সম্ভাবনা অধিক থাকায়, সরকারের স্থায়িত্বের ঝুঁকি থাকে; দ্বিতীয়ত, দলে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে দলীয় নেতার স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে এবং তৃতীয়ত, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন করার সুযোগ থাকে না। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি আমাদের দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক তথা মোড় পরিবর্তনকারী অনুষঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। পাশাপাশি তা বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়ণ, সুষ্ঠু নির্বাচন, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব এবং সুস্থধারার রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুতে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত, বিরাজমান নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন তথা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা শুরু করা। দিলীপ কুমার সরকার : কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)