ওয়েবসাইটে জাল নথি তুলে ৬৭ কোটির কর ফাঁকি


ওয়েবসাইটে জাল নথি তুলে ৬৭ কোটির কর ফাঁকি
তৈরি পোশাক কারখানা বি ব্রাদার্স লিমিটেড। যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন ছিলেন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি)। গত ৫ আগস্টের পর থেকে এই সাবেক এমপি পলাতক থাকলেও তার প্রতিষ্ঠান রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া সরকারের শুল্কছাড় সুবিধার ফ্রি অব কস্ট (এফওসি) সনদ জালিয়াতি করে বন্ডেড সুবিধায় শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করেছে সাড়ে ১৩ লাখ কেজি কাপড়। কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ)-এর ওয়েবসাইটে এফওসির জাল প্রত্যয়নপত্র আপলোড করে সরকারের ৬৬ কোটি টাকা শুল্ক-কর ফাঁকি দিয়েছে বি ব্রাদার্স লিমিটেড। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি—এই তিন মাসের ব্যবধানে এমন ভয়াবহ জালিয়াতি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর এতে সহযোগিতা করেছেন বন্ড কমিশনারেটের সিস্টেম অ্যানালিস্ট। অভ্যন্তরীণ তদন্তে ভয়াবহ এই জালিয়াতির চিত্র উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের শুল্ক-কর আহরণের বা কর ফাঁকির বিষয়ে নজরদারি অনেকটা ঢিলেঢালাভাবে চলতে থাকে। আর এই সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে নরসিংদীর সাবেক এমপি জহিরুল হক ভূঁইয়ার প্রতিষ্ঠান বি ব্রাদার্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি এফওসির জাল প্রত্যয়নপত্র ব্যবহার করে মাত্র তিন মাসে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার কেজি কাপড় আমদানি করে। আর এই প্রত্যয়নের কোনো অনুমোদন ছিল না। সাধারণত এফওসির প্রত্যয়ন ছাড়া পণ্য খালাসের সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে অভিনব জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকা দক্ষিণ বন্ড কমিশনারেট থেকে প্রত্যয়ন না নিলেও সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করা ছিল প্রত্যয়নপত্র। এতে কাস্টম হাউস দিয়ে নিয়ে আসা পণ্য সহজেই শুল্ক ফাঁকি দিয়ে নিয়ে যায় বি ব্রাদার্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির গত বছরের অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১০ নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমদানি করা পণ্যের চালান যাচাই করে জালিয়াতির এই ভয়াবহ চিত্রের প্রমাণ মেলে। আলোচ্য সময়ে বন্ড সুবিধায় নিয়ে আসা এসব পণ্যের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ছিল ৭৪ কোটি ৮৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪১৫ টাকা। আর এসব পণ্যে শুল্ক ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৬ কোটি ৬৪ লাখ ৬৬ হাজার ৭৭১ টাকা। প্রায় ৫৫টি পণ্য চালানের মাধ্যমে এই অনিয়ম করে বি ব্রাদার্স লিমিটেড। কোনো ধরনের প্রক্রিয়া ছাড়াই বন্ডেড সুবিধায় পণ্য নিয়ে আসে বি ব্রাদার্স গার্মেন্টস। জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বি ব্রাদার্স গার্মেন্টসের পলাতক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল হক মোহনের মোবাইল ফোনে কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে প্রতিষ্ঠানটির চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘কোম্পানির ভ্যাট-ট্যাক্সের বিষয়টি আমি দেখি না। যার কারণে রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি আমার জানা নেই।’ কোম্পানির ভ্যাট-ট্যাক্সের বিষয়টি যিনি দেখেন তার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো নম্বর দিতেও অপারগতা প্রকাশ করেন শফিকুল ইসলাম। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বি ব্রাদার্স লিমিটেডের এফওসির প্রত্যয়নপত্র বন্ড কমিশনারেটের ওয়েবসাইটে আপলোড হলেও অনুমোদনের কোনো নথি ছিল না। সবচেয়ে বড় অসংগতি হলো—এ সংক্রান্ত্র নথিতে প্রতিষ্ঠানটির কোনো আবেদনও পাওয়া যায়নি। ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবেদন থাকলেও ওয়েবসাইটে আপলোডের কোনো তথ্যই ছিল না বন্ড কমিশনারেটের কাছে। মূলত গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এই জালিয়াতিতে জড়িতদের চিহ্নিতে কমিটি গঠন করে বন্ড কমিশনারেট। আর এই কমিটির তদন্তে ঢাকা বন্ড কমিশনারেট দক্ষিণের সিস্টেম অ্যানালিস্ট গোলাম কবিরের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। সাধারণত বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের আমদানি প্রাপ্যতা, প্রত্যয়নপত্র ও এইচএস কোড সংক্রান্ত্র কোনো চিঠি আপলোড করার ক্ষেত্রে রেজিস্টারে এন্ট্রি থাকে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপকমিশনার বা সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আপলোড করার জন্য অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে সিস্টেম অ্যানালিস্টকে প্রতিটি আপলোডের ক্ষেত্রে ইমেইল করা হয়ে থাকে। কিন্তু বি ব্রাদার্সের এই এফওসি প্রত্যয়নপত্রের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনুমোদন বা অনুরোধ ছাড়াই সিস্টেম অ্যানালিস্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করেছেন। এজন্য তিনি তদন্ত কমিটির কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। শুধু কমার্শিয়ালদের (প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি) হাতে দেওয়া চিঠি বন্ড কমিশনারেটের ওয়েবসাইটে আপলোড করেছেন সিস্টেম অ্যানালিস্ট। যদিও তিনি নিজে স্বীকার করেছেন যে, বন্ড অটোমেশনের মাধ্যমে চিঠিগুলো আপলোড করার সুযোগ ছিল। আর সরকারের শুল্ক-কর ফাঁকির এই বিশাল জালিয়াতি তার মাধ্যমে সংঘটিত হওয়ার পর তিনি তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, বি ব্রাদার্সের বিষয়টি অসাবধানতাবশত হয়েছে, এজন্য তিনি লজ্জিত এবং আর ভবিষ্যতে হবে না বলেও জানিয়েছেন। তবে এই সিস্টেম অ্যানালিস্টের সহায়তায় বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঢাকা দক্ষিণের বন্ড কমিশনার লুৎফর রহমানের মোবাইল ফোনে দফায় দফায় কল করেও তার কোনো সাড়া মেলেনি। জানা গেছে, সিস্টেম অ্যানালিস্টের সহায়তায় এফওসির জাল প্রত্যয়নপত্র ওয়েবসাইটে আপলোড করে সরকারের বড় অঙ্কের কর ফাঁকি দেওয়ার কারণে বি ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। প্রতিষ্ঠানটির জাল এফওসি প্রত্যয়নপত্র ও এইচএস কোড সংক্রান্ত কোনো তথ্য বন্ড কমিশনারেটের কোনো নথিতে নেই। এই জালিয়াতি সিস্টেম অ্যানালিস্ট গোলাম কবীরের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে করা হয়েছে। তাই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করারও সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে বন্ড সুবিধা অপব্যবহার করে ৬৭ কোটি টাকা আদায়ের কার্যক্রম গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে কমিটি। শুধু এই অনিয়ম নয়, এর আগেও ২০২০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে অনিয়মের আশ্রয় নেয় প্রতিষ্ঠানটি। তখন শেয়ারমানি ডিপোজিটের টাকা নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে না রেখে একাধিক ব্যাংকে রাখে, যা আইপিওর (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) শর্তাবলি এবং কনসেন্ট লেটারের নিয়মাবলির লঙ্ঘন। এ ছাড়া কোম্পানিটির আইপিও আবেদনে ভবন নির্মাণের লে-আউট জমা না দেওয়া এবং আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফা বেশি করে দেখানোর অভিযোগে আইপিও বাতিল করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। আরও জানা গেছে, বি ব্রাদার্স লিমিটেডের এমডি জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন আওয়ামী লীগ ঘরনার ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯৯৬ সালে রূপগঞ্জের বরপায় গড়ে তোলেন তৈরি পোশাকের প্রতিষ্ঠান বি ব্রাদার্স লিমিটেড। সেখানে একটি কোম্পানির নামে দুটি ইউনিট হিসেবে ব্যবসা করছেন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দুবারের এমপি ছিলেন তিনি। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের ডামি নির্বাচনে নরসিংদী-৩ আসন থেকে এমপি হন।