কোটা সংস্কার ও নিশ্চিত জীবনের প্রত্যাশা
অনলাইন নিউজ ডেক্স
আজ কালকালকার দিনে একটি চাকরি সোনার হরিণ।আর সরকারি চাকরি হরিণ তো হিরা-পান্না দিয়ে তৈরি। রাষ্ট্রের কাছে লেখাপড়া শেষে একটি চাকরি প্রত্যাশা কি খুব অন্যায়? এটা তো যুক্তিযুক্ত দাবি।
এই দাবিতেই দেশের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা সংগ্রামরত সবাই সকল দলমতের উর্ধে গিয়ে তারা সমবেত হয়েছে। তাদের যুক্তি এবং দাবি কোটা সুবিধা সংস্কার করতে হবে এবং তা অবশ্যই ৫৬ শতাংশ হতে পারে না। সময় ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সংস্কার তো খুব সাধারণ প্রক্রিয়া। মনে রাখতে হবে, এই ছাত্র সমাজ ক্ষমতা পরিবর্তনের লড়াই লড়ছে না। মিছিলের মুখগুলো আমি দেখেছি, আন্দোলনকারীরা মধ্য-নিন্ম মধ্য খুব সাধারণ পরিবার থেকে মিছিলে সামিল হয়েছে, এটা সাদা চোখে দেখলেই বুঝা যায়। খুব বেশি সুবিধা প্রাপ্ত পরিবার থেকে ওরা আসেনি।
এটা তো সত্য যে, এ প্রজন্মের সন্তানদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত।তাই তো ওরা তাদের ভবিষ্যত নিশ্চিতের লক্ষ্যে সংগঠিত হয়েছে।দাবি আদায়ে প্রিয় ক্যাম্পাস থেকে রাস্তায় নেমেছে।
যদি বলি নিশ্চিত জীবনের নিশ্চয়তা নেই বলেই ওরা রাস্তায়। আমাদের নীতি নির্ধারনীরা পারেনি তাদের জীবনের স্বপ্নের বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে। যে নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত ছিল।
আমি বিভিন্ন সময়ে এ প্রজন্মের অনেকের সাথে কথা বলেছি, ওরা কেউ দেশে থাকতে চায় না, ওরা এখানে ভবিষ্যত দেখে না। নিরাপদ বোধ করে না। সবাই তো বিদেশে পারি দিতে পারবে না, সংখ্যাগড়িষ্ঠই যেতে পারবে না। যাদের উপায় নাই, তাদের কি হবে? কি উত্তর রয়েছে আমাদের? আমরা জনমিতিক লভ্যাংশের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি ২০১২ সাল থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত বহমান থাকবে .১৫-৬৪ বছর বয়সের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যে দেশে বেশি তারাই এই সুবিধা পায়।আমরা শতাংশে ৬৫.২৩% খুব আশার সংবাদ।যারা আন্দোলন করছে ওদের বয়স তো হবে বড়জোর ১৮-১৯-২৫ বছর, ওদের নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা কি?
জনমিতিক লভ্যাংশের সদ্ব্যব্যবহার করতে পারছি কি? পারবো কি?
সরকারি শুণ্যপদ ৩ লাখ ৭০ হাজার ৪৪৭টি (তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো-২৮ মে ২০২৪, জনপ্রশাসন মন্ত্রী) পদ পূরণের উদ্যোগ আছে কিন্তু সেখানেও আছে কোটা, স্বজনপ্রীতি আর সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, সাধারণ যাবে কোথায়? প্রতি বছর ২০ লাখের বেশি মানুষ দেশের শ্রমবাজারে আসছেন।এদের বছরে গড়ে প্রায় চার লাখের কর্মসংস্থান হচ্ছে তাও আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান খুবই কম।শিক্ষিত জনশক্তির মধ্যে বেকারত্বের হার আরও বেশি।৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর বাদ বাবি ২৬%। এই দিয়ে ৫৬ শতাংশ ৫৬ শতাংশ কোটায় আন্দোলনকারীরাদের বিরোধিতা। আমার প্রশ্ন আসলে কাদের জন্য কোটা? আমি নাগরিক হিসেবে মনে করি, সমাজে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীদের জন্য কোটা থাকতে হবে।
সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি বলতে চাই, দারিদ্র্যসীমার নিচে যে সকল মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন তাদের জন্য কোটা বিবেচিত হোক। আমাদের দেশ স্বাধীনে যারা জীবন বাজি রেখে বুক চেতিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন তারা কৃ্ষক , মজুর, ছাত্র, যুবক , শ্রমিক যাদের প্রায় ৮০% ছিলো গ্রামের মানুষ তারা ছিলেন নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারের সন্তান। গ্রামীন জনগোষ্ঠীর সেই সাধারন মানুষ যারা আমাদের দেশের জন্য কেউ যুদ্ধো শেষে জীবন নিয়ে ফিরেছেন কেউ ফিরেছেন অঙ্গ হারিয়ে বা দেশের স্বার্থে অকাতরে দিয়েছেন জীবন, তাদের ভুলে গেলে চলবে না । তারা যারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন তারা ভাতা বা কোটার আশায় যুদ্ধে যান নাই। তারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন দেশ, মাটি আর মানুষের মুক্তির আশায়। দরিদ্র সুবিধাবঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের খুজেঁ বের করতে হবে। দিতে হবে প্রাপ্য সম্মান। তাদের পরিবারের সদস্যদের মূলস্রোতের সাথে নিয়ে আসতে হবে দিতে হবে কোটা সুবিধা। তেলে মাথায় তেল আর কত? মুক্তিযুদ্ধা, নারী, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী , চরবাসী, হিজড়া, বেদেঁ, জেলে, শ্রমিক,কৃষক সবাইকে মূলস্রোতে নিয়ে আসা নীতি নির্ধারকদের দায়িত্ব। কোটার শতাংশের হার অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে। সবই ঠিক ছিলো একটি স্লোগান পাল্টে দিল দৃশ্যপট- সেই ঘৃণিত শব্দ “রাজাকার” এই স্লোগান সাধারণদের মিছিল থেকে ঊচ্চারিত হবে এটা প্রত্যাশিত ছিলো না। আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সচেতন মানুষ ও সাবেক ছাত্র আন্দোলনের কর্মী-সংগঠক হিসেবে খুব আহত হয়েছি, কষ্ট পেয়েছি। এই দেশে আমার সন্তানেরা রাজাকার পরিচয় দিয়ে স্লোগান দিবে এটা হতে পারে না।
থমকে গিয়ে ভাবলাম আন্দোলনে ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া দেওয়া হয়ে থাকে- এখানে সেটাই হয়েছে । সুযোগ সন্ধানী রাজাকার আর পাকবাহিনীর প্রেত্মাতারা সুযোগ বুঝে সাধারন আন্দোলনকারীদের দিয়ে নিজেদের সুবিধা আদায়ের পথ খোজাঁর চেষ্টা করেছে। বিএনপি তো প্রকাশ্যেই সমর্থন দিয়েছে। এই সমর্থনের মানে হচ্ছে আমার সন্তানের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে নিজেদের সকল ব্যর্থতা পিছনে ফেলে ক্ষমতা দখল! সরকার দলীয় সাধারন সম্পাদক ও ছাত্রলীগ ও কম যায় না। হেলমেট , হকি বাহিনী পাল্টা পাল্টি আঘাত করতে ছাড়েনি ছত্রীদেরকেও। গতকাল ১৬ই জুলাই, ঝরে গেল ৬টি প্রাণ । এদের মধ্যে একজন ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকার শ্রমজীবী হকার মো. শাহজাহান। কেনো হকার জীবন দিবে?
আক্রমণের পাল্টা পাল্টিতে শিক্ষক, সাংবাদিক কেউ বাদ যায়নি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালইয়ের নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদ । প্রথম আলোর সূত্রে যে ছবি দেখলাম সে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো সে বলছে হয় বিজয় না হয় মৃত্যু । সাঈদকে দেখে আমার সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের বিরোধী সংগ্রামে নূর হোসেনের গণতন্ত্রের জন্য জীবন দানের কথা মনে পড়ে যায়। রাজাকার স্লোগানের মধ্য দিয়ে সব সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকার বানানোর প্রবণতা সঠিক হবে না। ওরা আমাদেরই সন্তান, এ দাবি আমি ছাড়বোনা। ওদের অশুভ জামাত-বিএনপি কূটকৌশলে ব্যবহার করছে। অতি সামান্য কিছু জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীর কূটকৌশের কাছে প্রায় সব সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের জামাত বিএনপির দিকে ঠেলে দিবো এটা ঠিক হবে না। ওরা আশ্রয় না পেয়ে ব্যবহারিত হচ্ছে, এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতা স্বীকার না করলে মস্ত বড় ভুল হয়ে যাবে। আমরা সাধারণ ছাত্র সমাজের মন পড়তে পারি না- এটাও আমাদের নীতি নির্ধারকদের ব্যর্থতা।
এখনো সময় আছে, আশ্বাস নয় যুক্তিযুক্ত সমাধানের পথে এগুলে নিশ্চিত হবে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত। গভীর ষড়যন্ত্র ও সংকটের হাত থেকে রক্ষা পাবে আমার আপনার আমাদের প্রিয় স্বদেশ।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।