প্রস্তাবিত বাজেটকে (২০২৪-২৫) উচ্চাভিলাষী, ফাঁকা বুলি, বৈষম্যমূলক এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থহীন-এমন মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, এ বাজেট বে-নজির, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে মেলানো হয়নি এবং বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারের বরখেলাপ। আর কালোটাকা সাদা করার নিয়ম সংবিধান পরিপন্থি এবং জ্বালানি ও ব্যাংক খাত এবং পুঁজিবাজারের সমস্যাগুলো সমাধানের কেনো দিকনির্দেশনা নেই। শুধু তাই নয়, সেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে মানুষের চাওয়া ও গবেষণার প্রতিফলন নেই।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে সিপিডি ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫ ও বিরাজমান পরিস্থিতি : অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের পরিস্থিতি’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন বিশিষ্টজনরা।
এসজিডি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় অংশ নেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মাশরুর রিয়াজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মী, ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. খায়রুল ইসলাম, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় শিক্ষা অর্থনীতি অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. এ কে এনামুল হক, লেখক ও কলামিস্ট ইলিরা দেওয়ান, গণসাক্ষরতা অভিযানের উপ-পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
২০২৪-২০২৫ সালের প্রস্তাবিত বাজেটকে একটি বে-নজির বাজেট হিসাবে মন্তব্য করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকা সাদা করার যে নিয়ম রাখা হয়েছে তা সংবিধান পরিপন্থি। এই বাজেট বে-নজির বাজেট।
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে আমরা কোথাও কোনো স্বস্তি দেখি না। চলমান সময়ে পিছিয়ে পড়া মানুষজনকে সুরক্ষা দিতে হয়। বিভিন্ন খাতে দেখা গেছে প্রস্তাবিত বাজেটে সুরক্ষার বিষয়ে আশ্বস্ত হওয়ার কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে জ্বালানি খাত, ব্যাংক খাত ও পুঁজিবাজারসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার দেখা যায়নি। প্রস্তাবিত বাজেটে সুরক্ষা, স্থিতিশীলতা ও সংস্কারের বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের ঘোষিত নীতির সঙ্গে বাজেটে অন্তত পাঁচটি ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যত্যয় হয়েছে। ৭ জানুয়ারিতে যে নির্বাচন প্রক্রিয়া হয়েছে সেখানে বর্তমান শাসক দল যে ইশতেহার দিয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে তারা ইশতেহারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকেনি। নির্বাচনি ইশতেহারের বড় ধরনের বরখেলাপ হয়েছে। বর্তমান সরকারের যে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা আছে তার সঙ্গে বর্তমান প্রস্তাবিত বাজেটের কৌশল এবং বরাদ্দের মিল নেই।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তা প্রস্তাবিত বাজেটে মেলানো হয়নি। বাজেটে যেসব নীতি ও অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছিল তার সঙ্গে বাজেটের বরাদ্দ মেলে না। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব পদ্ধতিসহ বিভিন্ন বিষয় দেখলে বোঝা যায় সাধারণ মানুষের নয়, ব্যক্তি বিশেষের সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বর্তমান বাজেট একটি উচ্চাভিলাষী, ফাঁকা বুলির বাজেট। পাশাপাশি এটি বৈষম্যমূলক বাজেট, সেইসঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য একটি অর্থহীন বাজেট এটি।
তিনি আরও বলেন, এই বাজেটে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। এটি এমন একটি বাজেট, যা জবাবদিহিতাহীন। এটি দুর্নীতি সহায়ক ও অনৈতিক বাজেট। এই কথাগুলো বলার অবশ্যই যৌক্তিক কারণ আছে। প্রথমে যদি কালোটাকার বিষয়টি বলি-কালো টাকাকে বৈধতা দেওয়া যাবে না-এমন ঘোষণা কিন্তু আমাদের আছে। আপনি সৎভাবে উপার্জন করে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দেবেন, অন্যজন অনৈতিকতার সঙ্গে দুর্নীতি করে প্রচুর পরিমাণে আয় করে নামমাত্র ১৫ শতাংশ কর দেবেন। আবার এসব বিষয় নিয়ে কোনো প্রশ্নও তোলা যাবে না।
তিনি বলেন, যারা দুর্নীতি করছে তাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে, লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে সারা বছর অবৈধভাবে আয় করার জন্য। বছর শেষে রাজস্ব বিভাগ তাদের ক্লিন সার্টিফিকেট দেবে। অনেকে আবার শুদ্ধাচার পুরস্কার পাবেন, সেরা করদাতার পুরস্কারও পাবেন। এর মাধ্যমে দেশবাসীকে বোঝানো হচ্ছে তোমরা চাইলে এই পথটা অনুসরণ করো। এসবের কারণে আমরা আগামী প্রজন্মকে বলার সাহস পাব না যে তোমরা ভালো আদর্শ অনুসরণ করো।
সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান এই ব্রিফিংয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, আয়করে কোথায় ছাড় আছে সেটা বাজেটে বলা হয়েছে। বড় ভাবে ছাড় কমানো হয়েছে পরোক্ষ করে। গার্মেন্টস, জ্বালানি, মাইক্রোক্রেডিটের মতো প্রত্যক্ষ করের ছাড় ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই, আগামীতে কী করা হবে এই বিষয়ে দিকনির্দেশনা নেই। আয়করের ছাড়ের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই।
তিনি বলেন, বলা হয়েছে ১৫ শতাংশ নগদ অর্থ দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করা যাবে। কিন্তু গুলশান এলাকায় ফ্ল্যাট কিনলে ২.৩৮ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে আপনি বের হয়ে যেতে পারবেন। পুরো বৈধ হবে, একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে ১৫ শতাংশ নয় ২-৩ শতাংশ দিয়ে আপনি বের হয়ে যেতে পারবেন। সম্পূর্ণরূপে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে। কাউকে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। এটা মানা যায় না।
তৌফিকুল ইসলাম খান আরও বলেন, বাজেটে অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। আমরা খুবই আশাবাদী। এর থেকে চমৎকার স্বপ্ন আর হয় না। কিন্তু এটা বাস্তবায়নে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। যে কারণে আমরা অর্থনৈতিক সংকটে পড়লাম, সেটা ভালোভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলে বের হয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টর, সুশাসন নিয়ে আলোচনা নেই। বাজারে অনিয়ম, অর্থপাচার রোধে কী হবে, দায় দেনার ক্রাইসিস চিহ্নিত করা হয়নি। বড় আকারে আমরা ঋণের পরিস্থিতিতে পড়েছি সেটা স্বীকার করা হয়নি। গত অর্থবছরে বিদেশি ঋণশোধ করার জন্য আমাদের রাজস্ব যথেষ্ট ছিল না। আমরা প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ করে পরিশোধ করেছি।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শিক্ষার বাজেটের বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। শিক্ষা বাজেটের অবস্থা বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার মতো। কোনো বার দেখা যায় জিডিপির ১.৮ শতাংশ, আবার কখনো ১.৭ পার্সেন্ট। এটি নামতে নামতে এবার এটি ১.৭ এর নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু যারা বাজেট প্রণয়ন করেন, তারা জানেন, শিক্ষায় সঠিক বিনিয়োগ ব্যতীত কেনো দীর্ঘমেয়াদি বা টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে তারা যেকোনো কারণে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারেন না।
ড. মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের ১১টি অনুচ্ছেদেই শুধু পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা হয়েছে কিন্তু নির্দেশনামূলক কিছু নাই। কোভিডের পর থেকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য ২ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ বরাদ্দ আছে। একশ কোটি টাকার আরেকটি বরাদ্দ আছে গবেষণার জন্য। প্রশ্ন হলো, গবেষণার যেসব ফলাফল সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয় কি না? কারণ স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ গবেষণা করে পরিষ্কারভাবে দেখাচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৭০ শতাংশই পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়। মানুষের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় হয় ওষুধের জন্য। কিন্তু এগুলোর রিফ্লেকশন বাজেটে পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, তাই বাজেটে দিকনির্দেশনায় কিছু বিষয় থাকা উচিত। এই খরচ যারা করেন তারা নিম্ন আয়ের মানুষ। যদি বিশেষ বরাদ্দের দুই হাজার কোটি টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ দুই হাজার কোটি টাকার কিনি এবং এসব ওষুধ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বিভিন্ন জায়গায় দেই তাহলে মানুষের এই যে বাড়তি খরচ তা কয়েক শতাংশ কমে যেতে বাধ্য।
ইলিরা দেওয়ান বলেন, সামাজিক নিরাপত্তায় যে সুবিধাগুলো দেওয়া হয় সেই সুবিধাগুলো আদিবাসীরা খুব একটা পান না।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।