বিসিএসের প্রশ্নফাঁসের দায় স্বীকার ৬ জনের


বিসিএসসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০টি ক্যাডার-নন-ক্যাডার পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ছয়জন দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। মঙ্গলবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের (সিএমএম) চারটি পৃথক আদালতে তাদের জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। পরে গ্রেফতার ১৭ জনকেই কারাগারে পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে পিএসসির তিন কর্মকর্তাও রয়েছেন। তারা রহস্যজনকভাবে রয়ে গেলেন স্বীকারোক্তির বাইরেই। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে দুজনের রয়েছে বিসিএস প্রস্তুতির কোচিং বাণিজ্য। আরেকজন করতেন তদবির। এদিকে এক যুগেও বিসিএসের প্রশ্নফাঁসের অভিযোগের কোনো বিচার হয়নি। বছরের পর বছর ধরে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। পরে অভিযুক্তকে বদলির (লঘুদণ্ড) মাধ্যমে ফাইল নিষ্পত্তি হয়েছে। এদিকে গ্রেফতার ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সূত্র জানায়, সিআইডি ও আদালতে সাবেক গাড়িচালক আবেদসহ ছয়জন তাদের জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, গত এক যুগে পিএসসির ক্যাডার ও নন-ক্যাডারসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস তারা করেছেন। তাদের হাত ধরে অনেকেরই ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পদে চাকরি হয়েছে। এসব কর্মকর্তা বিভিন্ন দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। তবে এই সংখ্যা কত এবং এসব কর্মকর্তাদের কে কোন দপ্তরে রয়েছেন তা স্পষ্ট করেনি কেউ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পিএসসির বর্তমান ও সাবেক চার পরিচালক ও সহকারী পরিচালকসহ প্রশ্নফাঁস সিন্ডিকেটের ফ্রন্টলাইনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন ৩১ জন। তাদের সহযোগী হিসাবে সারা দেশে সক্রিয় রয়েছেন আরও ৫০ থেকে ৬০ সদস্য। ক্যাডার, নন-ক্যাডার পদে পরীক্ষায় ফাঁস করিয়ে দেওয়ার নামে নেওয়া হতো প্রার্থীদের কাছ থেকে ৪০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। প্রতিটি পরীক্ষায় কমপক্ষে ২০ জন করে প্রার্থী টার্গেট করা হতো। তাদের কাছ থেকে পরীক্ষার আগে প্রশ্ন এবং উত্তর তুলে দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হতো মোটা অঙ্কের অর্থ। আর এসব টাকায় তারা প্রত্যেকেই বনে গেছেন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। এই চক্রের পিএসসির উপর মহলের কোনো কর্মকর্তা জড়িত কিনা এই বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এই চক্রের হোতা পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী। তিনি প্রশ্নফাঁস চক্রের নেতৃত্ব দিয়ে শূন্য থেকে এখন শতকোটি টাকার মালিক। সিআইডির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই আবেদ প্রতারক শাহেদকেও হার মানিয়েছেন। সে সরকার এবং প্রশাসনের প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছবি তুলে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে নিজের ক্ষমতা জাহির করতেন। পিএসসির ড্রাইভার হলেও তার পৈতৃক নিবাস মাদারীপুরের ডাসার এলাকায় নিজেকে একজন শিল্পপতি এবং দানশীল হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করে আসছিলেন। হতে চেয়েছিলেন ডাসার উপজেলা চেয়ারম্যানও। শুধু তাই নয়, এই আবেদ পিএসসিতে ড্রাইভার পদে চাকরি নেওয়ার সময়ও ভুয়া স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। বিষয়টি পিএসসির নজরে আসে ২০১৪ সালে। ওই সময় নন-ক্যাডারের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চাকরি থেকে তাকে বরখাস্ত করে পিএসসি। বংশ পদবি মীর হলেও তা পালটে বনে গেছেন সৈয়দ। অন্যদিকে গ্রেফতার তিন কর্মকর্তার সহায়-সম্পদেরও হিসাব-নিকাশ চলছে। কেউ কেউ বলছেন, একজন ড্রাইভার যদি এত সম্পদের মালিক হয়ে থাকেন, তবে জড়িত পিএসসির কর্মকর্তারা কত সম্পদের মালিক? পিএসসির তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে গ্রেফতারের পর সোমবার রাতে পল্টন থানায় সরকারি কর্মকমিশন আইনে মামলা করে সিআইডি। ওই মামলায় ৩১ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ১৪ জন পলাতক রয়েছেন। গ্রেফতারদের মঙ্গলবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হকের আদালতে হাজির করেন সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা। তাদের মধ্যে ছয়জন আদালতে জবানবন্দি দিতে রাজি হন। আদালত গ্রেফতারদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন। গ্রেফতার আসামিরা হলেন-পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিকী, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক মো. মামুনুর রশীদ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান, ডেভেলপার ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া ছয়জন হলেন-পিএসসি চেয়ারম্যানের আলোচিত সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবন, পিএসসির ডেসপাস রাইটার খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম, ব্যবসায়ী দুই ভাই সাখাওয়াত হোসেন ও সাইম হোসেন এবং লিটন সরকার। ড্রাইভার আবেদের যত সম্পদ : বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী অন্তত দেড়শ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। ঢাকায় তার একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি রয়েছে। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ডুপ্লেক্স ভবন। এছাড়া স্ত্রী শিল্পী বেগমের নামেও গড়েছেন বিপুল বিত্তবৈভব। সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আবেদ এবং তার পরিবারের সম্পদ কোথায় কি আছে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঢাকার পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডের বিসমিল্লাহ টাওয়ার নামে নয়তলা ভবনের পঞ্চম তলায় দুই ছেলে, এক মেয়েসহ পরিবার নিয়ে থাকেন আবেদ আলী। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী সোহেল খান জানিয়েছেন, ওই ভবনের চতুর্থ তলা ও পঞ্চম তলায় আবেদ আলীর পাঁচটি ফ্ল্যাট ছিল। এর মধ্যে সম্প্রতি দুটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছেন। এছাড়া পাইকপাড়ায় তার একটি ছয়তলা ভবন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আবেদ আলীর নিজের নামে ধানমন্ডি ১৬ নম্বর রোডে ৩ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। যার মূল্য ৬ কোটি টাকা। চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটে ৩০০ বর্গফুটের একটি দোকান রয়েছে। যার মূল্য ২ কোটি টাকা। পূর্বাচলে রয়েছে ২০ কোটি টাকা মূল্যের স্থাপনাসহ ১০ কাঠা জমি। এছাড়া বাগেরহাটের গোলাপকাঠি গ্রামে রয়েছে ১০ কাঠা জমি। আবেদ আলীর স্ত্রী শিল্পী বেগমের নামে ধানমন্ডির ১১ নম্বর রোডে ২৪০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। যার মূল্য ৪ কোটি টাকা। মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে রয়েছে ৪৮২০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, নবোদয় হাউজিং সোসাইটির বি ব্লকে রয়েছে ১০ কোটি টাকা মূল্যের বহুতল বাড়ি, মানিকগঞ্জের রাখোরা মৌজায় রয়েছে ২০ বিঘা জমি, বাড্ডার সাতারকুল মৌজায় ৮ বিঘা জমি, পান্থপথে ৪০০ বর্গফুটের একটি দোকান, বায়তুল মোকাররমে ৩০০ বর্গফুটের দোকান, টেকনাফে তিন বিঘা জমি, কক্সবাজারের ইনানী সৈকতে স্থাপনাসহ এক বিঘা জমি, চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ৬ কাঠা জমি রয়েছে। এদিকে মাদারীপুরের কালকিনী প্রতিনিধি এইচএম মিলন জানান, গাড়িচালক হলেও মাদারীপুর জেলার ডাসার উপজেলার বাসিন্দা আবেদ আলী কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। জীবিকার তাগিদে মাত্র ৮ বছর বয়সে আবেদ আলী পাড়ি জমান ঢাকায়। প্রথমে সদরঘাটে কুলির কাজ করেন। রাত কাটিয়েছেন ফুটপাতেও। গাড়ি চালানো শিখে বাগিয়ে নেন বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনে (পিএসসি) গাড়িচালকের কাজ। প্রশ্নফাঁস চক্র গড়ে তোলে অর্জন করেন বিপুল সম্পদ, সঙ্গে ক্ষমতাও। আবেদ আলী ও তার ছেলে সিয়াম গ্রেফতারের পর মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামে উৎসুক জনতা তার আলিশান বাড়ি দেখতে ভিড় জমান। স্থানীয় সূত্র জানায়, সৈয়দ আবেদ আলী ওই গ্রামের মৃত আব্দুর রহমান মীরের ছেলে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে আবেদ মেজো। বড় ভাই জবেদ আলী কৃষি কাজ করেন, ছোট ভাই সাবেদ আলী এলাকায় অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। সরকারি জমি দখলসহ এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমি কিনেছেন আবেদ। নিজে এবং তার ছেলে সোহানও ব্যবহার করেন দামি গাড়ি। এলাকায় নিজেকে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী বলে প্রচার করতেন। গ্রেফতারের পর আবেদের ছেলে সোহানুর রহমান সিয়ামকে ছাত্রলীগের ঢাকা উত্তর ও মাদারীপুরের কমিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মামলায় উল্লেখ করা হয়, ৬ জুলাই সাইবার মনিটরিং করার সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সিআইডি জানতে পারে, ৫ জুলাই বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন আয়োজিত বাংলাদেশ রেলওয়ে সাব-এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নন-ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠানের আগে একটি সংঘবদ্ধ চক্র প্রশ্ন ফাঁস করে। তারা চাকরি প্রার্থী একদল পরীক্ষার্থীর কাছে অর্থের বিনিময়ে উক্ত প্রশ্ন ও প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করেছে। গোপন সংবাদ ও প্রযুক্তির সহায়তায় চক্রের সক্রিয় সদস্য সৈয়দ আবেদ আলী, মো. নোমান সিদ্দিকী, মো. খলিলুর রহমান, মো. সাজেদুল ইসলাম, আবু সোলেমান মো. সোহেল, জাহাঙ্গীর আলম, এসএম আলমগীর কবির, প্রিয়নাথ রায়, মো. জাহিদুল ইসলাম, মো. আবু জাফর, মো. শাহাদত হোসেন, মো. মামুনুর রশিদ, নিয়ামুল হাসান, মো. সাখাওয়াত হোসেন, সাইম হোসেন, লিটন সরকার ও সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামকে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মতিঝিল, বসুন্ধরাসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে আটক করা হয়। অভিযুক্ত পাঁচজনকে বহিষ্কার করল পিএসসি : সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির এবং পিএসসির কর্মচারী ডেসপাস রাইটার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলামসহ পাঁচজনকে চাকরি থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে পিএসসি। মঙ্গলবার পিএসসির চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত বহিষ্কারাদেশের কপিতে দেখা গেছে, ওই পাঁচজনকে চাকরি আইন অনুসারে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তারা বিধি অনুসারে খোরপোষ ভাতা পাবেন।