ভয়ের দেয়ালে আটকে গেছে শৈশব


ভয়ের দেয়ালে আটকে গেছে শৈশব
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে পুড়ে অঙ্গারসহ বহু হতাহতের ঘটনার পর শুধু ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিরই নয়, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আশপাশের লোকালয় ও বিদ্যাপীঠের অনেক শিশু ও তাদের অভিভাবকরাও। হঠাৎই বিমান আছড়ে পড়ার কানে তালা লাগানো শব্দ, বিকট বিস্ফোরণ, বুলেট গতিতে ছোটা বিমানের খণ্ড খণ্ড টুকরো, আর ছড়িয়ে পড়া জেট ফুয়েলে মুহূর্তেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আকাশ ছোঁয়া অগ্নিশিখার ভয়াবহতার আতঙ্ক জাগানিয়া পরিবেশ তাদের মনে ভয় গেঁথে দিয়েছে স্থায়ীভাবে। আশপাশের অনেক শিশুর আচরণে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। কেউ কেউ রাতে ঘুমাতে পারছে না, অনেক শিশু আবার ঘুমের মধ্যে ভয়-আতঙ্কে চিৎকার করে উঠছে। অভিভাবকরা বলছেন, সন্তানদের ঘুমে সমস্যা, অতিরিক্ত চমকানো কিংবা নীরব হয়ে যাওয়ার মতো আচরণ দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ স্কুলে যেতে অনীহা প্রকাশ করছে, আবার কেউ বা অল্প শব্দেই আতঙ্কিত হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ভুক্তভোগী এসব শিশুর (পুড়ে যাওয়া, বেঁচে যাওয়া, প্রত্যক্ষদর্শী) পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। ‘বিমান’, ‘আগুন’, ‘স্কুল’, এমনকি ‘সাইরেন’-এর শব্দেও ফ্ল্যাশব্যাক হতে পারে। ঘুমে ভয়, আঁকড়ে থাকা, নিজেকে দোষী ভাবার মতো বিষয় কাজ করতে পারে। তাদের কারও কারও আগুনের ক্ষত শরীরের চেয়ে গভীরভাবে মনে দাগ কাটে। এমন ট্রমা শিশুমনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। অভিভাবকদের এই সময়ে প্রয়োজন সন্তানদের কথা শোনা, তাদের নিরাপদ অনুভব করানো এবং প্রয়োজন হলে পেশাদার সাইক্রিয়াটিস্টের (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ) সহায়তা নেওয়া বা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা। ২১ জুলাই দেশের রাজধানী শহর ঢাকায় আর অন্য পাঁচটি দিনের মতোই চলছিল চিরচেনা ব্যস্ততা, যানবাহন ছুটছে, খুলেছে অফিস, বাজার জমছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছিল রুটিনমাফিক কার্যক্রম। নাগরিক জীবনের অবিরাম এই ছুটে চলার পথে কারও যেন এক দণ্ড সময়ও নেই থেমে একটু জিরোনোর। তবে ছন্দপতন ঘটে রাজধানীর শেষ প্রান্তের একটি অংশে। শ্রাবণের ভরদুপুরে একটি সামরিক বিমান আছড়ে পড়ায় উত্তরার একটুকরো ভূখণ্ড থমকে যায়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই লেলিহান আগুনে অঙ্গার হয় খুদে শিক্ষার্থীসহ অনেকে। আহতের সংখ্যাও কম নয়, যাদের অধিকাংশেরই পুড়েছে শরীরের বড় একটি অংশ। আকাশছোঁয়া অগ্নিশিখা যেন সবকিছুকে গ্রাস করে নিতে থাকে। ফায়ার সার্ভিস এবং সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয়দের সম্মিলিত তৎপরতায় অবশ্য ছড়িয়ে পড়া আগুনকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। তবে সেই আগুন এখানকার শিশু-কিশোর ও তাদের অভিভাবকদের মনে গভীর এক ক্ষতের দাগ রেখে গেছে। যার চিহ্ন তারা আর কখনো মুছতে পারবেন কি না তা অদূর ভবিষ্যতেই কেবল জানা যাবে। সব মিলিয়ে এই মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি স্থির হয়ে যাওয়া সময়—যেখানে ভয়ের দেয়ালে আটকে গেছে শত শত শিশুর শৈশব। উত্তরা এলাকার প্রতিটি স্কুলের গেটের সামনে, প্রতিটি মা-বাবার মুখাবয়বে এখন একটিই প্রশ্ন—‘আমার সন্তান কি স্কুল থেকে আর ফিরে আসবে?’ দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে হতাহত হয় বহু শিক্ষার্থী। মৃতদের কারও কারও দেহ এতটা পোড়া ছিল যে তা দেখে শনাক্ত করতে পারেননি বাবা-মা। শুধু উত্তরা নয়, ভয়ংকর এই দুর্ঘটনার পর রাজধানীর স্কুলপাড়াগুলোতে এক অজানা, অদৃশ্য আতঙ্ক ভর করেছে। এই আতঙ্ক কেবল দুর্ঘটনার নয়, এটি ভবিষ্যতেরও। এটি দগ্ধ শরীরের নয়, এটি জ্বলতে থাকা এক সমাজের মননের। দুই কন্যাসন্তানের মা সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার রুমা দাস কেয়া। তার মেয়েরা পড়াশোনা করে উত্তরার একটি খ্যাতনামা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। মাইলস্টোনের ঘটনার পরদিন থেকেই সন্তানদের আর স্কুলে পাঠাননি তিনি। জানতে চাইলে রুমা দাস বলেন, ‘চার দিন ধরে আমি আমার সন্তানদের স্কুলে পাঠাইনি। সারারাত ঘুমাতে পারি না, ওদের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমাদের মায়েদের বুকের ভেতরে জ্বলছে এক আগুন, এ আগুন আর কখনো নিভবে না। এ টালমাটাল সময়ে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো প্রতিদিন যুদ্ধ করছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, নিরাপত্তাহীনতা আর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার সঙ্গে। আমাদের একমাত্র ভরসা, একমাত্র স্বপ্ন হলো সন্তান। আজ এক মা মারা গেছেন শোক সহ্য করতে না পেরে। আমি দুঃখিত; কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা স্বস্তিও কাজ করছে যে, উনি অন্তত এ হাহাকার নিয়ে আর বাঁচবেন না। এ যন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যু হয়তো শ্রেয়।’ একটি দুর্ঘটনা, বহু বিদ্যালয়ের মানসিক পতন: মাইলস্টোনের পাশের সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, স্কলাস্টিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুল বাংলাদেশ, ডেলটা লাইফ স্কুল, উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ— সবখানে এখন যেন ভর করেছে একইরকম শোক-আতঙ্ক। সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সারাহ ইসলামের মা মাহমুদা আক্তার। তিনি বলেন, ‘ঘটনার পরদিন থেকে আমার মেয়ে স্কুলে যেতে চায় না। একটু শব্দ হলেই আঁতকে ওঠে। রাতে বলল, ‘মা, ওই ছেলেগুলোর মায়েরা তো সকালে ওদের হাসতে দেখেছিল, এখন তো তারা কবর দেখছে।’ আমি আর কোনো কথা বলতে পারিনি। সারারাত ওর পাশে বসে ছিলাম, ঘুমায়নি। যেন ওর নিঃশ্বাস ঠিকমতো চলছে কি না, সেটা অনুভব করছিলাম।’ আতঙ্কগ্রস্ত এ অভিভাবক আরও বলেন, ‘আগে ও (মেয়ে সারাহ) নিজেই হোমওয়ার্ক করত। এখন খাতা খুলতেই চায় না। সবসময় আমার হাত ধরে বসে থাকে। এমনকি বাথরুমে যেতেও ভয় পায়। মনে হয় আমার মেয়ে হঠাৎ বড় হয়ে গেছে; কিন্তু ভিতরটা একেবারে ভেঙে পড়েছে।’ একই দশা রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের শিক্ষার্থী সাফায়েত আহমেদের বাবা সাইফুল ইসলামের। তিনি চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, “আমি ছেলেকে স্কুলের গেটে নামিয়ে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আব্বু, যদি এমন কিছু হয়, আমি কি আর তোমাকে দেখতে পারব না?’ আমি ওকে কী উত্তর দিতাম? চার দিন ধরে ও কিছু খায় না। সারাদিন এক কোণে বসে থাকে। ওর চোখে আমি একটা চাপা ভয়ের ছায়া দেখি, যেটা কোনো পড়ার চাপ বা বকাঝকার নয়, এটা মৃত্যুর ছায়া।” মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির পর ভীতিকর পরিস্থিতিতে নিজের দিন পার করার চিত্র তুলে ধরে স্কলাস্টিকার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মারিয়া রহমান। এই শিক্ষার্থী বলে, ‘সেদিন যখন নিউজটা শুনলাম, তখন ক্লাস চলছিল। স্যার এসে বললেন, সবাই চুপ করে থাকো। একটা দুঃসংবাদ আছে। তারপর জানতে পারি আমাদের ভাইবোনের বয়সী ছেলেমেয়েরা মারা গেছে। সারাক্ষণ শুধু ওদের মুখ মনে পড়ছে। রাতে ঘুমাতে পারি না। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয়, সেই প্লেনটা আমাদের ওপর এসে পড়বে।’ ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুল বাংলাদেশ অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌসের মা রেহানা আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়ে আগে খুব প্রাণচঞ্চল ছিল। এখন যেন একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেছে। কেবল জানালার দিকে চেয়ে থাকে। বলে, ‘মা, আমরা কি আসলেই নিরাপদ?’ ডেলটা লাইফ স্কুলের শিক্ষার্থী মাহিরা ও মাহিম- দুই ভাইবোন। তারা একই স্কুলে পড়াশোনা করে। বোন মাহিরা তাদের শোকাতুর অনুভূতি প্রকাশ করে বলে, ‘আমি আর ভাইয়া প্লেন দেখতে খুব ভালোবাসতাম। সেদিন ইউটিউবে ভিডিওতে দেখলাম প্লেনটা কীভাবে পড়েছিল। তারপর থেকে প্লেনের শব্দ শুনলেই কাঁদতে ইচ্ছে করে। আমার মনে হয় আমি ওর ভেতরেই ছিলাম।’ মাহিরার মা রেজওয়ানা চৌধুরী বলেন, ‘এ দুর্ঘটনার পর মনে হলো সন্তানদের আলাদা আলাদা স্কুলে ভর্তি করাব। ভাবছি, ওদের দুই ভাই-বোনকে একসঙ্গে স্কুলে না পাঠিয়ে আলাদা স্কুলে ভর্তি করাব। ভয় হয়, একসঙ্গে কিছু হয়ে গেলে আমি কাউকে আর ফিরে পাব না।’ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সন্তানদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি, ভালো মানুষ হবে, লেখাপড়া শিখে বড় হবে। কিন্তু এখন শুধু একটা ভয় তাড়া করে- ওকে স্কুলে পাঠানোর পর যদি আর ফিরে না আসে? এ ভয় নিয়ে আমরা প্রতিদিন বাঁচি। এটা কি কোনো সভ্য সমাজের চিত্র হতে পারে।’ আগুন থেকে বেঁচে ফেরার গল্প: ভয়াবহ আগুন, ধোঁয়ায় ভরা কক্ষ, চারপাশে আতঙ্ক আর মৃত্যু নামের যমদূতের ছায়া। সেই মৃত্যুকূপ থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে ফিরে এসেছে এক কিশোর। উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার আগুন থেকে প্রাণে রক্ষা পায় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সূর্য। তার সাহসিকতা ও মানবিকতার গল্প তুলে ধরেছেন মা ডা. শারমিন ইসলাম সাথী। ফেসবুকে দেওয়া তার এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়ার পর তা আলোড়ন তুলেছে বহু মানুষের হৃদয়ে। শারমিন ইসলাম লেখেন, ‘আমার ছেলে সূর্যের একটা ভিডিও দেখলাম টিভিতে, যেখানে ওকে স্কুল ভবনের কার্নিশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু সূর্য কীভাবে বেঁচে গেল, সেটা অনেকেই জানেন না। সেই গল্পটা বলি। ঘটনাটি ঘটে ২০ জুলাই রোববার। সেদিন স্কুলে না যাওয়ায় পরদিন সূর্য তার হোমওয়ার্ক শেষ না করেই ক্লাসে যায়। ফলে তাকে পাঠানো হয় ‘ডিটেনশন ক্লাসে’, যেখানে পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত সময় ধরে পড়ে। সূর্যসহ পাঁচজন শিক্ষার্থীকে রাখা হয় ভবনের এক কোণার একটি রুমে। ঠিক তখনই তারা দেখতে পায়, মূল ক্লাসরুমের সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। একজন সহপাঠী পালাতে গিয়ে মুহূর্তেই আগুনে পুড়ে যায়, চোখের সামনে মৃত্যু দেখতে হয় অন্য কিশোরদের। আতঙ্কে তারা সরে আসে নির্ধারিত কক্ষে, যেখানে তখনো আগুন পৌঁছায়নি। তবে তাপমাত্রা পৌঁছায় প্রায় ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, আর পুরো ঘর ভরে ওঠে ঘন ধোঁয়ায়। শ্বাস নিতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, শরীরের ভেতরটাই যেন পুড়ে যাচ্ছে। অবস্থা কিছুটা স্থিত হলে সূর্য জানালার পাশে গিয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে সাহস করে বারান্দায় বের হয়। বাইরে থেকে কয়েকজন তাকে ডানদিকে যাওয়ার ইশারা করে। সেই দিকে তাকিয়ে সূর্য দেখে একটি গ্রিল কেটে তৈরি করা হয়েছে পালানোর পথ। কিশোর সূর্য তখন নিজের জীবন নিয়ে না ভেবে প্রথমে বন্ধুদের ডাকে এবং তাদের আগে নিচে নামার সুযোগ করে দেয়। তারপর নিজেও কার্নিশ ধরে সাহসিকতার সঙ্গে নিচে নেমে আসে।’ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার পর শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল গবেষক, অ্যাসিস্ট্যান্ট কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ও রিস্টার্ট সাইকোলজিক্যাল কনসালট্যান্সির প্রধান নির্বাহী ইসমাত আরা ইতি। জানতে চাইলে ইতি বলেন, ‘এ দুর্ঘটনার পর শিশুদের মধ্যে যে ভয় ও উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে, তা নিছক সাময়িক নয়, এটি এক ধরনের ট্রমার প্রকাশ। আগে শিশুদের কাছে স্কুল ছিল এক আনন্দময়, নিরাপদ জায়গা। প্রতিদিনের খেলাধুলা, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা, শেখার আগ্রহ—সবকিছু মিলিয়ে স্কুল ছিল প্রিয় একটি গন্তব্য। কিন্তু এখন স্কুল শব্দটাই তাদের কাছে ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে।’ এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘শুধু দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত শিশুরাই নয়, যারা টিভি, মোবাইল বা অন্যান্য মাধ্যমে এ ঘটনা দেখেছে কিংবা শুনেছে, তারাও একই ধরনের আতঙ্কে ভুগতে পারেন। তাদের ঘুমে সমস্যা হতে পারে। অনেক সময় হঠাৎ চিৎকার করে জেগে উঠতে পারেন। খাওয়া-দাওয়ার প্রতি অনাগ্রহ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যারা নিজের আবেগ ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না, তাদের মধ্যে এই ট্রমা আরও গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।’ ট্রমার লক্ষণ ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নিয়ে ইসমাত ইতি বলেন, ‘ট্রমা মূলত মানসিক আঘাত। আমরা সাধারণত বলি, একটি মানসিক আঘাতের প্রাথমিক ধাক্কা প্রায় এক মাস থাকে। একে যদি সময়ে চিহ্নিত করে সহায়তা না করা হয়, তবে সেটি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে রূপ নিতে পারে।’ শিশুদের ট্রমা মোকাবিলায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও দেন এই মনোবিজ্ঞানী। তার মতে, অভিভাবকদের করণীয় হলো, সন্তানদের সামনে সাহসী মনোভাব প্রদর্শন করা, নিজেদের মানসিক চাপ গোপন রাখা, সন্তানদের মনোযোগ অন্যদিকে নিতে সচেষ্ট থাকা। স্কুলের ভূমিকা: একটি ‘সেফ স্পেস’ তৈরি করা, যেখানে শিশুরা আঁকাআঁকি, খেলাধুলা ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। ট্রমা-ইনফর্মড কাউন্সেলিং চালু করা, অভিজ্ঞ কাউন্সেলরের সহায়তায় ইনডিভিজুয়াল থেরাপি ও গ্রুপ সেশন আয়োজন করা। শিক্ষকদের ট্রেনিং দিয়ে শিশুদের আবেগ চিনতে শেখানো মনোচিকিৎসকের উপস্থিতি: প্রতিটি স্কুলে একজন সাইকোলজিস্ট থাকা জরুরি। শিশুর ভয় বা আচরণগত পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত করে সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা। অভিভাবকদেরও কাউন্সেলিং দেওয়া উচিত। যাতে তারা শিশুর পাশে থাকতে পারেন সঠিকভাবে ভয়ের ধীরে ধীরে প্রতিকার: কোনো শিশুকে জোর করে স্কুলে পাঠানো যাবে না। ধাপে ধাপে এক্সপোজার থেরাপির মাধ্যমে তাকে প্রস্তুত করতে হবে। যেমন—বাসায় স্কুল রুটিন মেনে চলা। বন্ধু বা শিক্ষকের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলা। স্কুলের ড্রেস পরে বাড়ির সামনের মাঠে ঘুরে আসা। প্রথমে ১০-১৫ মিনিট স্কুলে গিয়ে বসা। পরদিন অল্প সময়ের ক্লাস করা—এভাবে ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়া। নতুন কিছু আয়োজন: স্কুলে খেলাধুলা, ট্যুর, প্রতিযোগিতা বা নতুন ধরনের প্রোগ্রাম চালু করা, যাতে শিশুদের মন অন্যদিকে যায় এবং স্কুলে ফেরার প্রতি উৎসাহ বাড়ে। জানতে চাইলে সরকারি বাঙলা কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান, মনোবিজ্ঞানী ও গবেষক অধ্যাপক ড. শাহিনারা বেগম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোবাইল ফোনে বলেন, ‘উত্তরার এ ঘটনাটি একটি ভয়াবহ মানব সৃষ্ট দুর্যোগ। এ দুর্যোগাক্রান্ত শিশু ও নারী। আর দুর্যোগ-পরবর্তী শিশু ও নারীরা বেশি মানসিক চাপের মধ্যে চলে যাবে। যেসব শিশু-কিশোর মারা গেছে, তাদের পরিবারের সদস্যরা ভয়াভয় দুঃসহ স্মৃতির ভার সহ্য করতে না পেরে বিভিন্ন রোগাক্রান্ত হতে পারে, যেমন ডায়াবেটিস উচ্চরক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাকের মতো অবস্থা হতে পারে।’ ড. শাহিনারা বেগম আরও বলেন, ‘শিশুদের ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন, ক্ষুদামন্দা ভয় আতঙ্কে থাকবে। ইনসোমেনিয়ার শিকার হতে পারে, শ্রেণিকক্ষ তাদের কাছে দুর্বিসহ লাগবে। পড়াশুনাকে আপদ মনে করবে, বমি বমি ভাব, জ্বর, এমন কি পাতলা পায়খানাও হতে পারে। শুধু ওই স্কুলের শিশুরা নয়, যে সকল শিশু টিভি বা অন্য কোনো মাধ্যমে এ ঘটনা দেখেছে তাদের মধ্যেও এটি সংক্রমিত হতে পারে। অনেক শিশু মা-বাবা হারিয়েছে, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে বেশ সময় লাগবে।’