মাতৃভাষার প্রশ্ন থেকে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন


পুরাতন বাংলা সাময়িক পত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে অনেকেই বিস্মিত হবেন যখন দেখবেন, বাংলার মুসলমানদের মাতৃভাষা কী- এ প্রশ্নে এক সময়ে এ দেশে বিতর্ক হয়েছে। বিতর্কে এক পক্ষ মতপ্রকাশ করেছে, বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দু এবং অপর পক্ষ মতপ্রকাশ করেছে, বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর তৎকালীন পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল, তার সঙ্গে ওই পুরাতন বিতর্কের সম্পর্ক আছে। উর্দু ভাষা এবং বাংলার উর্দুভাষী পরিবারগুলোর উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস অনুসন্ধান এবং উত্তরকালের ঘটনাবলি লক্ষ্য করলে এটা বোঝা যায়। জানা যায়, ১৯৪০-এর দশকের প্রথমদিকেও কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলা পত্রিকার চেয়ে দৈনিক উর্দু পত্রিকার সংখ্যা বেশি ছিল। ইতিহাসে দেখা যায়, উর্দু ভাষার উদ্ভব ঘটেছে ভারতবর্ষে, মোগল আমলে। উর্দু শব্দের অর্থ সৈন্য কিংবা সৈন্যদের তাঁবু। মোগল আমলে ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণি গঠিত হয়েছিল তুর্কি-মোগল, ইরানি, আফগান প্রভৃতি বিদেশি দ্বারা। বিদেশিদের সহযোগী দেশি লোকও শাসকশ্রেণির নিম্নস্তরে ছিল। মোগল প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে নিম্নস্তরের সরকারি কর্মচারী ও সিপাই ছিল দেশি লোক। পাইক-পেয়াদা ও নিম্নস্তরের কর্মচারীরা দেশি লোক হলেও সর্বস্তরের আমলারা ছিলেন বিদেশি। সেনাবাহিনীতে সিপাই-সান্ত্রীরা দেশি লোক হলেও সর্বস্তরের কমান্ডে ছিলেন বিদেশিরা। নায়েব-গোমস্তা দেশি হলেও জমিদার-জায়গিরদার, মনসুবাদার-সুবাদার ছিলেন বিদেশি। বাংলার রাজনীতিতে বিদেশি শাসকরা এসেছিলেন আক্রমণকারী ও বিজয়ীরূপে। তুর্কি-মোগল, ইরানি ও আফগানদের মাতৃভাষা ছিল তাদের নিজ নিজ দেশের ভাষা। ওই কালে সরকারি দপ্তরের ভাষা ছিল প্রধানত ফার্সি; আর সিপাই ও নিম্নস্তরের কর্মচারী এবং জনসাধারণের ভাষা ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা, হিন্দুস্তানি ভাষা। সেকালে শাসনকার্যে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা এবং বিভিন্ন ভাষার লোকদের পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদানের বহুভাষার স্থলে এক ভাষা ব্যবহারের তাগিদ অনুভূত হতো। মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই তুর্কি শাসকদের আমলে এই প্রক্রিয়া সূচিত হয়েছিল এবং এর মধ্য দিয়েই ক্রমে একটি স্বতন্ত্র ভাষারূপে উর্দু ভাষার উদ্ভব ঘটে। তবে এটাও সত্য, বহিরাগত কিছু লোক দেশের সাধারণ লোকদের সঙ্গে মিশে গিয়ে দেশি ভাষা গ্রহণ করেছে এবং ক্রমে স্বাতন্ত্র্য হারিয়েছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের সেসব পরিবারেরই মাতৃভাষা উর্দু, যেসব পরিবার মধ্যপ্রাচ্য ও তার উত্তর পাশের বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে এসে শতাব্দীর পর শতাব্দী স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছে। ওই বিদেশিদের ভাষার সঙ্গে ভারতীয়দের ভাষার মিশ্রণের মধ্য দিয়ে খোট্টা ভাষা, কুট্টি ভাষা, মুসলমানি বাংলা (দোভাষী পুঁথির ভাষা, মিশ্র ভাষা) ইত্যাদি গড়ে ওঠে। বহিরাগতদের ধর্ম ও মতাদর্শের সঙ্গে দেশি ধর্ম ও মতাদর্শের সংশ্নেষণের ফলে গড়ে ওঠে নানক, কবির, শ্রীচৈতন্য, আকবর, দারাশিকো প্রমুখের মতাদর্শ। মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য-এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতবর্ষে আগত এবং শাসক, কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও ভাগ্যান্বেষী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বেশ কিছু লোক শত শত বছর ধরে ভারতবাসী থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছে। ভারতবর্ষের জনসমুদ্রে তারা বিলীন হতে চায়নি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ভারতবর্ষকে তারা মাতৃভূমিরূপেও গ্রহণ করতে চায়নি। শত শত বছর ধরে তারা ভারতবর্ষে বসবাস করেছে প্রবাসী মন নিয়ে। হিন্দুদের থেকে যেমন, তেমনি ধর্মান্তরিত স্থানীয় মুসলমানদের থেকেও তারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখেছে। বিয়েশাদি তারা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। তারা বংশমর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট থেকেছে। দেশি মুসলমানদের সঙ্গে বহিরাগত মুসলমানরা বৈবাহিক সম্পর্কে আসেনি। তবে উর্দুভাষীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকদের রক্তমিশ্রণ যে একেবারেই ঘটেনি, তা নয়। বহিরাগতরা নিজেদের পরিচয় দিয়েছে \'আশরাফ\' বা অভিজাত বলে এবং স্থানীয় মুসলমানদের তারা অভিহিত করেছে \'আতরাফ\' বা নীচ জাত বলে। নানা কারণে \'জাতে তোলা\'র এবং \'জাতে ওঠা\'র ব্যাপারও এর মধ্যে ছিল। দেশি লোকদের মধ্য থেকে যারা শক্তিমান ও বিত্তবান হয়েছে, তারা নানা উপায়ে জাতে উঠেছে। তারা বহিরাগত বলে আত্মপরিচয় দিতে আরম্ভ করেছে। ভারতে এবং বাংলায় উচ্চশ্রেণির হিন্দুরা বহিরাগত মুসলমানদের অভিহিত করেছে \'যবন\' বলে। যবনে-ব্রাহ্মণে সব সময়েই বিরোধ ছিল। আশরাফরা ছিল যবনদেরই নিম্নস্তর। যবন শব্দটির অর্থ বিদেশি। ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাভাষী ভূভাগে প্রায় আটশ বছর ধরে \'যবন\' ও \'আশরাফ\' মুসলমানরা স্থানীয় \'আতরাফ\' মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব করেছে। তারা হিন্দুদের ওপরেও কর্তৃত্ব করেছে। নানা ঐতিহাসিক কারণে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অর্থবিত্ত, শিক্ষাদীক্ষা ও ক্ষমতার দিক দিয়ে স্থানীয় বাংলাভাষী মুসলমানরা বহিরাগত উর্দুভাষী মুসলমানদের চেয়ে অনেক পশ্চাৎবর্তী ছিল। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলেও অবস্থা অনেকটা এ রকমই ছিল। লাহোর, দিল্লি, এলাহাবাদ, লক্ষেষ্টৗতে আশরাফ মুসলমানদেরই কর্তৃত্ব ছিল। বাংলাভাষী মুসলমানরা যখন শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর হলো, প্রথম পর্যায়ে বাংলার শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে বাংলাভাষীদের চেয়ে উর্দুভাষীরা প্রবল ছিল। ধীরে ধীরে তারা দুর্বল হয়েছে। সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলার উর্দুভাষী মুসলমানরা নিতান্তই অল্প ছিল; কিন্তু তারাই ছিল শাসক। বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমানরা ছিল শাসিত। বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক নেতৃত্বও ছিল আশরাফদের হাতে। তারা এ দেশের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে চায়নি; আভিজাত্যবাদী কায়েমি-স্বার্থবাদী মন নিয়ে তারা চলত। তুর্কি, পাঠান, মোগল আমলজুড়েই বাংলার অবস্থা ছিল এই রকম। তবে পাঠানদের আচরণ ছিল একটু ভিন্ন। তারা এ দেশীয় সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করতে চাইত এবং ক্রমে তারা দেশি লোকদের সঙ্গে মিশে গেছে। পাঠানদের দেশ আফগানিস্তান ভারতবর্ষের সংলগ্ন। পাঠান সুলতানদের কালে দুইশ বছর বাংলা দিল্লির শাসন থেকে মুক্ত ছিল। ওই সময়ে শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণব ধর্মকে নবরূপ দিয়ে প্রচার করেন। সে সময়ে বাংলা সাহিত্যের অনেক উন্নতি ঘটে। বাংলার ভূভাগের উর্দুভাষী মুসলমানরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকেই তাঁদের স্বদেশ ভেবেছেন এবং এ দেশকে ভেবেছেন প্রবাসস্থল। ধারাবাহিকভাবে এসব ব্যাপার লক্ষ্য করলে বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না, কী কারণে এ দেশে এক সময়ে প্রশ্ন উঠত- বাংলার মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা, না উর্দু। উনিশ শতকের শেষ দুই দশক এবং বিশ শতকের প্রথম তিন দশকব্যাপী বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা, না উর্দু- তা নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হয়। মধ্যযুগে বাংলা ভাষার প্রতি আশরাফদের মনোভাব অবজ্ঞাপূর্ণ ছিল। মুসলমান যবন শাসকরা কিছু ব্যতিক্রম সত্ত্বেও নিজেদের শাসনক্ষমতা রক্ষা করার জন্য উদার নীতি নিয়ে চলেছেন। সতেরো শতকের সন্দ্বীপের কবি আবদুল হাকিমের সর্ববিদিত উক্তি :\'যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী...।\' যাঁরা কেবল ফার্সি ভাষা চর্চা করতেন এবং বাংলার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করতেন, তাঁদের উদ্দেশে মধ্যযুগের মুসলিম কবিদের কটূক্তি অনেক পাওয়া যায়। যবনদের প্রতি হিন্দু কবিদের কটূক্তিও অনেক পাওয়া যায়। তুর্কি, মোগল, ইরানিরা এ দেশে এসে রাতারাতি ভারতীয় কিংবা বাঙালি হয়ে যায়নি। আসলে তারা বাঙালি হয়েছে ধীরে ধীরে; বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে। ১৯৬০-এর দশকে বদরুদ্দীন উমর প্রবন্ধ লিখেছিলেন \'মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন\' নামে। আইয়ুব খান তাঁর \'প্রভু নয়, বন্ধু\' বইতে উল্লেখ করেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা আরব-ইরান থেকে আগত। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানের যে সভায় বলেছিলেন, \'উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা\'; ওই জনসভায় তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, পূর্ব বাংলার মুসলমানরা আরব, ইরান, ইরাক থেকে আগত। আসলে যবন বা বিদেশ থেকে আগত শাসকদের ইতিহাসকেই এঁরা বাংলার জনসাধারণের ইতিহাস মনে করতেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি থেকে মীরজাফর পর্যন্ত শাসকদের ইতিহাস আর ঢাকার খাজা পরিবার কিংবা টাঙ্গাইলের গজনবি পরিবারের ইতিহাস দিয়ে কি বাংলার মুসলমান জনসাধারণের ইতিহাস বোঝা যাবে? জিন্নাহ থেকে আইয়ুব-ইয়াহিয়া পর্যন্ত সবাই খাজা-গজাদের ইতিহাসকেই পূর্ব বাংলার মুসলমান জনগণের ইতিহাস মনে করেছেন। মধ্যযুগে এবং ইংরেজ আমলেও বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা ভারতের ও বাংলার তুর্কি মোগল শাসকরা অভিহিত হয়েছেন \'যবন\' বা \'বিদেশি\' বলে। বাংলার বহিরাগত মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া এখনও চলছে, শেষ হয়ে যায়নি। ইতিহাসকে নানাভাবে বিকৃত করা হচ্ছে। ভারতে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের ব্যাপ্তি ও গভীরতা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, পাকিস্তান আন্দোলন- সব ঘটনাতেই বহিরাগত মুসলমানদের \'প্রবাসী মানসিকতা\' আর দেশীয় মুসলমানদের \'আত্মবিস্তৃতি\' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। শুধু ধর্মের পার্থক্য এবং ধর্মকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক ব্যবধান এত জটিল ও ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটাতে পারত না। এথনিক বৈষম্যের ব্যাপার ছিল। ব্রিটিশশাসিত ভারতে ও বাংলায় এই এথনিক ব্যবধান- একদিকে বহিরাগত মুসলমানদের প্রবাসী কর্তৃত্ববাদী, আধিপত্যবাদী মানসিকতা এবং অন্যদিকে জাতিভেদ ও ব্রাহ্মণবাদী মানসিকতা হিন্দু-মুসলিম বিরোধকে তীব্র করেছে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে রাষ্ট্রভাষা সমস্যার সৃষ্টি করেছে। ব্রিটিশশাসিত ভারতে জাতীয়তাবাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতাবাদ। ব্রিটিশ সরকারের \'ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি\'র অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়েছেন জিন্নাহ, নেহরু, গান্ধী। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মাতৃভাষা বিতর্ক রূপান্তরিত হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিতর্কে। বাংলাদেশে এমন লোক আজো আছেন, যাঁরা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি থেকে মীরজাফর পর্যন্ত কিংবা কুতুবুদ্দিন আইবেক থেকে বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত শাসক, আমলা, সৈনিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিজেদের রক্তসম্পর্ক প্রমাণের প্রচেষ্টায় সীমাহীন উর্বর মস্তিস্ক ও কল্পনাশক্তির পরিচয় দিতে পারছেন। ইতিহাসকে যথোচিত গুরুত্ব দিচ্ছেন না। সবাই দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখছেন ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও আনুষঙ্গিক কিছু ঘটনাতে। পেছনে গেলে বড়জোর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গিয়ে থাকেন। আমাদের জাতির ইতিহাস এত অল্প সময়ের নয়। অতীতে বিভিন্ন ঐতিহাসিককালে এ জাতির জীবনে ভালো-মন্দ অনেক ঘটনা ঘটেছে। সেসব ঘটনাকে বাদ দিয়ে কেবল ঘটনাবলিতে দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখা যে কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য আত্মঘাতী ব্যাপার। ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলে ইতিহাস অনুশীলনে অগ্রসর না হয়ে আমাদের জাতি ইতিহাসচেতনাহীন মনের পরিচয় দিচ্ছে। দার্শনিক হেগেলের একটি উক্তি :ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। বাংলাদেশে আমরা যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাচ্ছি, যে লেখকদের পাচ্ছি, তাতে হেগেলের এই পর্যবেক্ষণেরই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। গত দুইশ বছরের মধ্যে পৃথিবীর অনেক জাতি নানাভাবে হেগেলের এই উক্তিকে অযথার্থ প্রমাণ করেছে। তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে। হেগেলের আরেকটি পর্যবেক্ষণ :যে জনসাধারণ যখন যেমন নেতৃত্বের যোগ্য হয়, সেই জনসাধারণ তখন ঠিক সেই রকম নেতৃত্বই লাভ করে। জনগণ কি ইতিহাসের গতিকে অভীষ্ট খাতে পরিচালিত করার মতো শক্তির অধিকারী হতে পারে না? কার্ল মার্ক্সের লেখায় আছে, জনগণই ইতিহাসের স্রষ্টা। কী রকম জনগণ? ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে যে রকম জনগণ দেখা যাচ্ছে, সেই রকম জনগণ? মার্ক্স যে জনগণের কথা বলেছেন, সেই জনগণ কল্যাণকর আদর্শ-অবলম্বনকারী নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত সংঘবদ্ধ জনগণ; উন্নত চরিত্রের নেতৃত্ব ছাড়া জনগণ ভালো কিছু করতে সমর্থ হয় না। মহান নেতৃত্ব সৃষ্টিতে জনগণেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। বাংলাদেশে জনগণের ভূমিকা কেমন? এখন পৃথিবীর প্রায় সব জাতির মধ্যে দেখা যাচ্ছে ইতিহাসের পশ্চাৎ গতি। পরিত্যক্ত, পুরাতন সব সংস্কার-বিশ্বাস পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে আর রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার বেড়ে চলেছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি আদর্শকে জনগণের কাছে অর্থহীন করে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশে যে রাজনীতি চলছে, তা দ্বারা কি এ রাষ্ট্রে ইতিহাসের সম্মুখগতি সম্ভব হবে? পৃথিবীর প্রায় সব জাতির মধ্যে চলছে গণবিরোধী শক্তির প্রবলতর অভিযাত্রা। গণজাগরণের ধারা শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিণত হয়ে আছে এক অপসংস্কৃতির রাষ্ট্রে। গণবিরোধী অভিযাত্রার বিরুদ্ধে গণজাগরণ ও জনগণের নবযাত্রার সূচনা করতে হবে। এ জন্য ভবিষ্যৎ দৃষ্টি নিয়ে ইতিহাস চর্চার প্রয়োজন খুব বেশি। সৃষ্টিশীল কর্মমুখী ইতিহাসচর্চার প্রয়োজন অন্তহীন। সর্বোপরি দরকার নতুন রাজনীতি ও নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আর এসবের পটভূমিতে দরকার নতুন রেনেসাঁস। সবই হবে, কিন্তু স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে হবে না। রাজনৈতিক মহল ও বিদ্বৎসমাজে দরকার সৃষ্টিশীলতা। বাংলাদেশে এখন যে অবস্থা চলছে তাতে আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকালের চেতনা হারিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী বৃহৎ শক্তিবর্গ। চীন হুমকি দিয়েছে- বাংলাদেশ যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী জোটে যুক্ত হয় তা হলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক থাকবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উস্কানিতে রাশিয়া যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে চরম বিপর্যয়ে পড়ে গেছে। কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থ জোগান দিতে দিতে যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধে পরিণত করে চলেছে। মনে হয়, গোটা মানব-প্রজাতি এক মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি। বাংলাদেশের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে যাওয়া উচিত হবে না। ভারতকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বলয় থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। দক্ষিণ এশিয়ার সব রাষ্ট্রেরই উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বলয় থেকে মুক্ত থাকা। \'যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই\'- এই দাবি নিয়ে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের সরকার ও জনগণেরই কর্তব্য যুদ্ধবিরোধী শান্তিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলা। এই বাস্তবতায়ও বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের কর্তব্য নিজেদের জাতি ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করা এবং প্রগতির ধারায় অগ্রসর হওয়া। এর জন্য অনেক কিছু করতে হবে। জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গণঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। বাংলা ভাষাকে উন্নত করতে হবে বাংলাদেশকে উন্নত করার জন্য। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এই বিপর্যয়ের কালেও পাকিস্তানকালের বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের মতো একটি সংস্থা গড়ে তোলা দরকার। ১৯৭২ সালে বাংলা উন্নয়ন বোর্ডকে বিলুপ্ত করা ঠিক হয়নি। আজকের নতুন বাস্তবতায় সংস্থাটিকে নতুন রূপ ও প্রকৃতি দিতে হবে। এ কাজে সরকার উদ্যোগী না বলে দেশের বিদ্বৎসমাজকে ক্ষতি স্বীকার করে হলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষাকে উন্নত করার কাজ করে যেতে হবে। সংস্কৃত ভাষা, ফার্সি ভাষা ও ইংরেজি ভাষার চাপের মধ্যে থেকেও বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের এই কালেও আশা করি, বাংলা ভাষা টিকে থাকবে এবং উন্নত হবে। বাংলা ভাষা বাঙালির অস্তিত্ব থেকে নিঃসৃত এবং বাঙালির অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। বাংলা ভাষা উন্নত হলে বাঙালি উন্নত হবে। বাঙালি উন্নতি করতে চাইলে তার ভাষা, তার জাতি ও তার রাষ্ট্রকে উন্নত করতে হবে। দলীয় সংকীর্ণতা পরিহার করে সর্বজনীন কল্যাণে রাজনীতিকে উন্নত করতে হবে। রাজনীতির গুরুত্ব সবাইকেই উপলব্ধি করতে হবে। উন্নতির অন্তহীন সম্ভাবনা আছে। সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য নেতৃত্ব চাই- নতুন মহান নেতৃত্ব। জনসাধারণের ঘুমিয়ে থাকলে হবে না, জাগতে হবে। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক: শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক