রেললাইনে মাসে ৭৫ লাশ
অনলাইন নিউজ ডেক্স
রাজধানীর মহাখালী রেলগেট। ইয়ারফোন লাগিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেলপথ পার হচ্ছিলেন ২০ বছরের তরুণ নাফিজ সামি। তখন একই লাইনে কমলাপুর রেলস্টেশনের দিকে ছুটছিল \'অগ্নিবীণা\' ট্রেন। ইয়ারফোন থাকায় ট্রেনের আওয়াজ, এমনকি আশপাশের মানুষের চিৎকারও তাঁর কানে পৌঁছায়নি। মুহূর্তেই ট্রেনে কাটা পড়ে জীবননাশ। গত ২৭ জানুয়ারি মর্মন্তুদ এ ঘটনায় নিহত নাফিজ সামি ছিলেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
রেললাইন পার হতে গিয়ে এমন ঘটনা এখন মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। রেলপথ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গেল পাঁচ বছরে দেশের নানা প্রান্তের রেললাইন থেকে মিলেছে ৪ হাজার ৫২৩ লাশ। গড় হিসাব করলে প্রতি মাসে দাঁড়ায় ৭৫ জন। যেসব লাশ পাওয়া গেছে এর মধ্যে ইয়ারফোন থাকায় মারা গেছেন ৫৫ জন। সেই সঙ্গে তাড়াহুড়া করে রেললাইন পার হতে গিয়ে ১ হাজার ৭৭৩ এবং রেললাইনের ওপর বসে থাকা বা চলাচলের সময় আরও ১ হাজার ৯৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশই ঢাকা রেলপথ থানা এলাকার।
রেলপথ পুলিশ ও রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, বেশিরভাগ মৃত্যুর কারণ অসচেতনতা-অসতর্কতা। তাই জনসচেতনতা বাড়াতে জোর দিয়েছে তারা। সেই সঙ্গে দুর্ঘটনা রোধে ঢাকা থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত রেললাইনের কোথাও দেয়াল আবার কোথাও লোহার তারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আরও যেসব স্থান ঝুঁকিপূর্ণ, সেসব স্থানেও বেড়া দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এভাবে খুব একটা সুফল মিলবে না। বরং ঢাকার প্রেক্ষাপটে মেট্রোরেলের মতো সাধারণ ট্রেনের চলাচলও উড়ালপথে হওয়া উচিত। তাহলে যেমন দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে, তেমনি গতি বাড়বে রেলের।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, রেললাইনে সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। সেখানে কারও যাওয়ার কথা নয়। তবে প্রায়ই দেখা যায়, লোকজন মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটছেন বা লাইনে বসে আছেন। আসলে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটা যাবে না।
এদিকে মহাপরিচালক নিষেধ করলেও অনেক স্থানে রেললাইন পার হওয়া ছাড়া গন্তব্যে পৌঁছানোর ভালো বিকল্প নেই। ঢাকায় মূলত দ্রুত যাতায়াতের সুবিধার্থে বা শর্টকাট পথ হিসেবে অনেকেই রেললাইন পার হতে বাধ্য হন। আবার ঢাকার বাইরে অনেক স্থানে মূল সড়কে পৌঁছানোর জন্যই ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে যাওয়া রেললাইন পার হতে হয়। এতে প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানি। এ ছাড়া বৈধ রেলক্রসিংয়েও ঘটছে অনেক দুর্ঘটনা। কারণ বৈধ ১ হাজার ৪১২টি রেলক্রসিংয়ের ৯৪৬টিতেই নেই গেটকিপার। আর অবৈধ ক্রসিং আছে অন্তত ১০০টি।
সংশ্নিষ্টরা জানান, ঢাকা মহানগরে রেললাইন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ভেতর দিয়ে যাওয়ায় এই অংশে ট্রেনের ধাক্কায় বা কাটা পড়ে মৃত্যুর হার বেশি। এর মধ্যে কুড়িল, বনানী ও মহাখালী এলাকায় প্রায়ই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। রাজধানীর কুড়িল থেকে প্রগতি সরণির দিকে যেতে রেললাইন পার হতে হয়। ওই স্থানে কুড়িল উড়াল সড়ক চালুর পর রেললাইনের দুই পাশে দেয়াল তুলে পারাপার ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন অনেকে। বিকল্প না থাকায় তাঁরা ঝুঁকি নিয়ে দেয়ালের পাশ দিয়েই প্রতিদিন রেললাইন পার হচ্ছেন। আবার মহাখালী, কারওয়ান বাজার ও মগবাজারে দেখা যায়, যানবাহন ও জনচলাচল ঠেকাতে লেভেলক্রসিং বার (যান চলাচল প্রতিবন্ধক) নামানোর ব্যবস্থা আছে। তবে ট্রেন কিছুটা দূরে আছে ভেবে লোকজন প্রতিবন্ধকের পাশ দিয়ে ঠিকই পার হচ্ছেন। তখন ঘটছে দুর্ঘটনা। ঢাকায় কিছু স্থানে রেললাইনের পাশে বেড়া দেওয়া হলেও লোকজন সেই বেড়া কেটে চলার পথ তৈরি করে নিয়েছে।
নিহত ৩১১ শিক্ষার্থী, ৩৭০ চাকরিজীবী :রেল পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে ১ হাজার ২, ২০১৯ সালে ৯৮০, ২০২০ সালে ৭১৩, ২০২১ সালে ৭৭৮ ও ২০২২ সালে ১ হাজার ৫০ জনের লাশ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৩১১ শিক্ষার্থী, ৩৭০ জন চাকরিজীবী ও ২ হাজার ৬৪ জন শ্রমজীবী ছিলেন। তথ্য বিশ্নেষণে দেখা যায়, নিহতদের ৩ হাজার ৪৫৮ জন পুরুষ ও ১ হাজার ৬৫ জন নারী। সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সীরা, সংখ্যায় তা ২ হাজার ৯৯৩ জন। আবার নিহত ৩৫৩ জনের বয়স ১৮ বছর বা এর চেয়ে কম। পঞ্চাশোর্ধ্ব ছিলেন ১ হাজার ১৭৭ জন।
রেলপথ পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক দিদার আহম্মেদ বলেন, মানুষকে সচেতন করতে আমরা বিভিন্ন স্টেশন ও যেসব জনবসতিপূর্ণ এলাকার মধ্য দিয়ে রেলপথ গেছে, সেসব স্থানে অনুষ্ঠান করছি। নানাভাবে প্রচারণা চালাচ্ছি। আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থানে রেললাইনের পাশে বেড়া এবং কোথাও কোথাও রেলগেট নির্মাণ করা দরকার। এ ব্যাপারে রেল কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করার পর তারা কিছু নির্মাণ করেছে, কিছু বাকি রয়েছে।
ঢাকায় ১২৪৮ মৃত্যু, ঝুঁকিপূর্ণ তেজগাঁও-বিমানবন্দর: ঢাকা রেলপথ থানা এলাকার ট্রেন লাইনে গত পাঁচ বছরে ১ হাজার ২৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ২২৮, ২০১৯ সালে ২৭১, ২০২০ সালে ২১৯, ২০২১ সালে ২৪৩ ও ২০২২ সালে ২৮৭ জন মারা গেছেন।
ঢাকা রেলপথ থানার (জিআরপি) ওসি ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস বলেন, তেজগাঁও থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত রেললাইনে মৃত্যু ঘটছে বেশি। অমনোযোগী হয়ে, ইয়ারফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন পারাপারের সময় এসব মৃত্যু হয়।
সব মৃত্যু দুর্ঘটনায় নয়: রেললাইন থেকে যত লাশ উদ্ধার হয়, তার সবই যে দুর্ঘটনা এমন নয়। অনেক সময় হত্যাকাণ্ড আড়াল করতে লাশ ফেলে রাখা হয় রেললাইনে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে উদ্ধার করা লাশের মধ্যে ১০২ জন ছিলেন হত্যাকাে র শিকার। এর বাইরে কিছু ঘটনা তদন্তে আত্মহত্যা হিসেবেও প্রমাণিত হয়।
উড়ালপথে ট্রেন চালানোর পরামর্শ: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ দেশে, বিশেষ করে ঢাকার ভেতরে মাটির ওপর দিয়ে রেল চালানো কোনো দূরদর্শী পরিকল্পনা নয়। যানজটের শহরে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে মানুষ অনেক সময় বাধ্য হয়ে শর্টকার্ট হিসেবে রেললাইন পার হয়। তাছাড়া চারপাশে অনেক শব্দের কারণে ট্রেনের আওয়াজ শুনতেও পায় না। ঢাকায় রেললাইনের পাশে বেড়া-দেয়াল দেওয়া হলেও কার্যকর সুফল মেলেনি। এ ক্ষেত্রে শুধু অসতর্কতা বা অসচেতনতাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বরং যাঁরা সব দিক না ভেবে, সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া এসব করেছেন, তাঁরা এই মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না।
তিনি বলেন, ঢাকার প্রেক্ষাপটে সাধারণ ট্রেনের চলাচলও উড়ালপথে হওয়া উচিত। তাহলে যেমন দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে, তেমনি রেলের গতি বাড়বে। বর্তমানের ৫০-৬০ কিলোমিটারের বদলে যদি ১৫০-২০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব হয়, তাহলে কম সংখ্যক ট্রেন দিয়ে আরও ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব। আর ট্রেনের গতি যখন এমন হবে, তখন মানুষ নিচের সড়ক ছেড়ে ওপরের ট্রেনে যাবে। এতে ক্রমেই বেড়ে চলা যানজট কমে আসবে।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।