শিবচরে বাস খাদে, নিহত ১৯


মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় ঢাকাগামী ইমাদ পরিবহণের যাত্রীবাহী বাস পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে খাদে পড়ে ১৯ জন নিহত হয়েছে। এতে আরও ২০ জন আহত হয়েছেন। রোববার সকালে শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন মারা যান। পরে হাসপাতালে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ১৭ জনের নাম-পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। শিবচর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু নাঈম মোফাজ্জেল হক জানান, বাসটি বেপরোয়া গতিতে চালানোর কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। তিনি বলেন, যাত্রীদের কাছ থেকে জানা গেছে-দুর্ঘটনার সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল এবং বাসটির সামনের বাম পাশের চাকা ফেটে যায়। এ কারণে চালক বাসটি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। ওসি আবু নাঈম আরও জানান, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে যাই। গিয়ে দেখি হাইওয়ে সড়ক থেকে বাসটি ছিটকে ৫০ মিটার দূরে আন্ডারপাসের নিচে পড়ে আছে। আহতদের দ্রুত প্রথমে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিবচরে হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনজন মারা যান। আহতদের মধ্যে গুরুতর ১২ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে দুজন মারা যান। তাদের নাম পরিচয় জানা যায়নি। ঘটনাস্থল ও পাশের হাসপাতাল থেকে ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করে বিকাল ৪টার মধ্যে সেগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শিবচর থানা হাইওয়ে পুলিশ জানায়, রোববার ভোরে খুলনার ফুলতলা থেকে ইমাদ পরিবহণের ঢাকাগামী যাত্রীবাহী বাসটি (ঢাকা-মেট্রো-ব-১৫-৩৩৪৮) কিছু যাত্রী নিয়ে ছেড়ে আসে। এরপর গোপালগঞ্জের বাসস্ট্যান্ড থেকে ১৪ জন যাত্রী বাসটিতে ওঠে। সকাল ৭টার দিকে পদ্মা সেতুর আগে এক্সপ্রেসওয়ের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি নিচে পড়ে যায়। এ সময় দুমড়েমুচড়ে যায় বাসটি। বাসটিতে চালক ও হেলপারসহ ৪৫ জন ছিলেন। তাদের মধ্যে ১৯ জন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন-গোপাগঞ্জের গোপীনাথপুরের তৈয়ব আলী মিয়ার ছেলে মো. হেদায়েত মিয়া (৪২), গোপালগঞ্জ সদর পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক ও সদরের শান্তি রঞ্জনের ছেলে অনাদী মন্ডল (৫২), সদরের বনগ্রামের শামসুল শেখের ছেলে মোস্তাক আহমেদ, সদরের নওশের আলীর ছেলে মো. সজিব, সদরের পাচুরিয়ার মাসুদ মিয়ার মেয়ে সুইটি আক্তার (১২), সদরের আবু হেনা মোস্তফার মেয়ে আফসানা মিমি (১১), সদরের মোকসদপুরের আমজেদ আলীর ছেলে মাসুদ (৩২) ও টুঙ্গিপাড়ার কাঞ্চন শেখের ছেলে কবির শেখ, ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার সৈয়দ মুরাদ আলীর ছেলে ইসমাইল (৩৮), খুলনার চিত্র রঞ্জনের ছেলে চিন্ময় রঞ্জন ঘোষ (১৬), সোনাডাঙ্গা উপজেলার শেখ মোহাম্মাদ আলীর ছেলে শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন (৪৫), ডুমুরিয়ার পরিমল সাধুখার ছেলে মহাদেব কুমার সাদুখা (১৫), খুলনা জেলার আমতলা গ্রামের শাজাহান মোল্লার ছেলে আশফাকু জাহান লিংকন, নড়াইলের লোহাগড়ার ফকু শিকদারের ছেলে ফোরহাদ শিকদার এবং ইমাদ পরিবহণের চালক ব্রাহ্মবাড়িয়ার আলমগীরের ছেলে জাহিদ হোসেন ও হেলপার পাবনার সুজানগরের গহর আলী শেখের ছেলে ইউসুফ হোসেন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন, পুলিশ সুপার মাসুদ আলমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আহত প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। আর নিহতদের পরিবারকে দাফন কাফন বাবদ ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনাকবলিত বাসটি শিবচর হাইওয়ে থানা পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনা তদন্তে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিবুল ইসলাম বলেন, ১৭ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মাদারীপুর পুলিশ সুপার মাসুদ আলম জানান, সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত করে জানা যাবে কেন দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। শিবচর ফায়ার সার্ভিসের গ্রুপ লিডার তরুনুর রশিদ খান বলেন, সংবাদ পেয়ে আমরা দ্রুত ঘটনা স্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করি। দুর্ঘটনা স্থলসহ হাসপাতালে ১৭ জন মারা গেছে। তদন্ত কমিটি গঠন : সড়ক দুর্ঘটনা তদন্তে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুনের নির্দেশে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পল্লব কুমার হাজরাকে প্রধান করে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান ফকির (পিপিএম), বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক শাহনেওয়াজ হাসানাত-ই-রাব্বি, মাদারীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হোসেন। আগামী দুই কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, ইমাদ পরিবহণের বাস দুর্ঘটনায় নিহত ১৯ জনের মধ্যে যে ১৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৯ জনের বাড়িই গোপালগঞ্জে। এছাড়া খুলনার চারজন, বাকিরা বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা। ঘুম ভাঙলে দেখি রক্ত আর লাশ! : ‘সবকিছুই যেন দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঘটে গেছে। আমি বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম ভাঙার পর দেখি রক্ত আর লাশ! হাতে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙে আমার। বাসের মধ্যে থেকে কে বের করে এনেছে জানি না।’ এভাবে শিবচরের দুর্ঘটনার বর্ণনা দেন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী এলাকার যুবক উজ্জ্বল। তিনি বলেন, ‘শুরু থেকে বাস দ্রুতগতিতে চলছিল। এক্সপ্রেসওয়েতে যাত্রীদের অনেকেই নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিলেন তখন। কেউ চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার সময় কিছুই টের পাইনি। যখন জ্ঞান ফেরে দেখি চারপাশে রক্ত আর লাশ। উঠে বসতে গেলে মাথা ঘুরে পড়ে যাই। পরে কিছুটা সুস্থবোধ করলে চারপাশে বোঝার চেষ্টা করি। তখন টের পাই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে গেছে! সড়ক থেকে গাড়ি উলটে নিচে পড়ে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে।’ খুলনার রূপসা এলাকার যাত্রী আহত মহারাজ খাঁ বলেন, বাসটি শূন্যে উঠে লাফিয়ে নিচে পড়ে গেল। অনেকবার উলটে নিচে পড়ে বাসটি। আরিফ শেখ নামের খুলনার আহত আরেক যাত্রী বলেন, দ্রুতগতিতে চলছিল বাসটি। মুহূর্তেই রাস্তার রেলিং ভেঙে উলটেপালটে নিচে পড়ে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে মনে হয়েছিল। বিদেশ যাওয়া হলো না তাসমিমের বাবার : অনেক স্বপ্ন ছিল শিশু তাসমিমের বাবা মোস্তাক আহমেদের। সিঙ্গাপুরে গিয়ে তিনি সংসারের সচ্ছলতা আনবেন। তাই ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট’ করাতে ইমাদ পরিবহণে রওয়ানা হয়েছিলেন ঢাকায়। কিন্তু পথে বাসটি খাদে পড়ে মোস্তাকের সঙ্গে তার স্বপ্নেরও মৃত্যু হয়েছে। গোপালগঞ্জের বনগ্রামের বাড়ি থেকে শিবচর উপজেলা হাসপাতালে আসা পাঁচ বছরের শিশু তাসমিম আহমেদের চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়লেও কিছুতেই বুঝতে পারছে না যে তার বাবা আর কোনোদিন ফিরবেন না। মা জোনাকি বেগমের বুকফাটা কান্না দেখে সেও চিৎকার করে কাঁদছে। সদ্য স্বামীহারা জোনাকি বেগম জানান, তার স্বামী সিঙ্গাপুর যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। শ্রমিক ভিসায় বিদেশ গিয়ে তিনি সংসারের অভাব ঘোচাতে চেয়েছিলেন। সেজন্যই ঢাকা গিয়ে ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট’ করাতে তিনি সকালে বাড়ি থেকে রওয়ানা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার আর ঢাকা যাওয়া হলো না। ‘সন্তানকে বুকে জড়িয়ে শুধু আল্লাহকে ডাকছিলাম’ : শিবচরের ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা আনোয়ারা বেগম (২৫) জানান, ‘হঠাৎ কী যে হইলো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনে হলো মাথায় আসমান ভেঙে পড়তাছে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে রেখে আল্লাহকে শুধু ডাকছিলাম। মুহূর্তের মধ্যেই সব ঘটে গেল।’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে এভাবেই দুর্ঘটনার বর্ণনা দেন আনোয়ারা। পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনাকবলিত ঢাকাগামী ইমাদ পরিবহণের যাত্রী ছিলেন তিনি। রোববার ভোরে বাসটি খাদে পড়ে ১৯ জন প্রাণ হারান। আনোয়ারা এবং তার শিশু সাজ্জাদকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছে উদ্ধারকর্মীরা। উদ্ধারের পর অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন আনোয়ারা। কিছুক্ষণ পর ঘটনার ভয়াবহতা দেখে আঁতকে ওঠেন এবং সন্তানকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। বারবার আল্লাহকে ডাকেন এবং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানান। বাগেরহাটের মোল্লারহাটের গারফা গ্রামের তাহিম মোল্লার স্ত্রী তিনি। মোল্লারহাট থেকে তিনি বাসে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়িটি বেশ দ্রুতগতিতে চলছিল। কিছুক্ষণ পরই পদ্মা সেতু। এমন আলোচনা করছিল যাত্রীরা। হঠাৎ করেই গাড়িটি রাস্তা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছিল। ওই সময়ে শুধু সন্তানকে জড়িয়ে রেখেছিলাম। ঢাকার ধানমণ্ডি বড় বোনের বাসায় যাচ্ছিলাম। দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার মুহূর্তে মনে হয় জ্ঞান ছিল না। গাড়ির মধ্য থেকে কে বা কারা বের করে আনছে তা মনে নেই। স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে এখনো।’ এদিকে খবর পেয়ে আনোয়ারার পরিবারের সদস্যরা ঘটনাস্থলের দিকে রওয়ানা দিয়েছেন। এখন আর ঢাকায় বোনের বাসায় যাবেন না, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যাবেন বলে জানান তিনি। আনোয়ারা বেগমের ছেলে সাজ্জাদকে প্রশ্ন করা হলে সে বলে, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারি নাই। মায়ের কোলে ছিলাম।’