হেরেও জিতে গেলেন হিরো আলম


আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের সংসদ সদস্যপদে নির্বাচন করা এবারই প্রথম নয়। ২০১৮ সালেও তিনি বগুড়ার একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। সেবার জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটের অঙ্কে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন না। এমনকি কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে প্রতিপক্ষের হামলারও শিকার হয়েছেন। ১ ফেব্রুয়ারি উপনির্বাচনে বগুড়ার দুটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে একতারা প্রতীক নিয়ে অংশ নেন হিরো আলম। ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টি তাঁকে মনোনয়ন দিলেও এবার তাঁদের দুয়ারে গিয়ে পাত্তা পাননি জনপ্রিয় ইউটিউবার হিরো আলম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা পেতেও চেষ্টা ছিল তাঁর। সবদিকে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই মাঠে নামেন তিনি। মনোনয়নপত্রে ত্রুটি থাকায় উভয় আসনে প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায় হিরো আলমের। রিটার্নিং কর্মকর্তার যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে নির্বাচন কমিশনে আপিল করলেও হেরে যান তিনি। অবশেষে হাইকোর্টের আদেশে প্রার্থিতা ফিরে পান। বগুড়ায় নির্বাচন করলেও সারাদেশের মানুষের আগ্রহ ছিল তাঁকে নিয়ে। তাঁর প্রচারণার কৌশল সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। তিনি যখন নির্বাচনী এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছেন; শত শত শিক্ষার্থী আগ্রহভরে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছে। এটিকে তাঁর জীবনের বড় অর্জন বলে দাবি করেছেন। পশুর হাটেও প্রচারণায় সরব ছিলেন আলোচিত-সমালোচিত হিরো আলম। বগুড়া র‌্যাব অফিস থেকে ফেরার পর সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন- আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে তাঁকে তলব করা হয়েছিল কিনা। জবাবে হিরো আলম বলেছেন, চায়ের দাওয়াতে গিয়েছেন। ইতোমধ্যে কথাবার্তায়ও রাজনৈতিক পরিপক্কতা রপ্ত করেছেন। একসময় হিরো আলমকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপহাসকারীর সংখ্যাই ছিল বেশি। এবার দেখা গেছে উল্টো চিত্র। দেশের নানা প্রান্ত থেকে তাঁর পক্ষে ভোট প্রার্থনা করে পোস্ট দিতে দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর পক্ষে কথা বলতে দেখা গেছে বিএনপির পদত্যাগকারী একজন সংসদ সদস্যকেও। নায়িকা মুনমুন বগুড়া গিয়ে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। এ রকম অনেক ভক্তও গিয়েছেন। এত মানুষের ভালোবাসা অর্জন হিরো আলমের জীবনে কম পাওয়া নয়। বগুড়া-৪ আসনে মাত্র ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন হিরো আলম। ওই আসনে দেশের দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি তথা নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থী ছিল না। মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাসদের রেজাউল করিম তানসেন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তানসেন এর আগেও সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁর মতো হেভিওয়েট প্রার্থীর হিরো আলমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৮৩৪ ভোটে বিজয়ী হওয়া খুব কৃতিত্বের বিষয় নয়। একতারা প্রতীকে হিরো আলম ১৯ হাজার ৫৭১ ভোট পেয়েছেন। আর মশাল প্রতীকে রেজাউল করিম তানসেন পেয়েছেন ২০ হাজার ৪০৫ ভোট। মহাজোটের প্রার্থী মানে আওয়ামী লীগের ভোটও মশালে যাওয়ার কথা। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে হিরো আলমের অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের তদন্ত বা আদালতের মাধ্যমে হিরো আলমের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কী আসে, সেটি পরের বিষয়। কিন্তু তিনি এবার যেভাবে সাড়ে ১৯ হাজার মানুষের ভোট পেলেন এবং সারাদেশে একটি সেন্টিমেন্ট সৃষ্টি করলেন, তাতে হেরে গিয়েও জিতে গেলেন হিরো আলম। ভোটের হিসাবনিকাশে দেখা যায়, উপনির্বাচন এমনকি মূল নির্বাচনেও আগের মতো ভোটার উপস্থিত হচ্ছে না। ১৫-২৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির কথা নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে। সেখানে ১৯ হাজার মানুষ যে সশরীরে কেন্দ্রে গিয়ে একজন হিরো আলমকে একতারা প্রতীকে ভোট দিয়েছে; এটি নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্ত। ফলাফল ঘোষণার শুরুর দিকে এগিয়ে থাকা হিরো আলমের অভিযোগ, শেষের দিকে ফলাফলে কারচুপি হয়েছে। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে শিক্ষিত মানুষকে তাঁকে \'স্যার\' ডাকতে হবে বলেই এ হারানো। এই \'শিক্ষিত\' বলতে হিরো আলম যে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ইঙ্গিত করেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। একজন সিডি বিক্রেতা, ডিশ ব্যবসায়ী থেকে উঠে আসা হিরো আলমের সংসদে যাওয়ার স্বপ্ন এবারের মতো থেমে গেলেও ভবিষ্যতে কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে। বয়সের তুলনায় অনেক দূর এগিয়ে আসা হিরো আলমের জন্য শুভকামনা। হাইকোর্টের নির্দেশে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়া হিরো আলমের কয়েকটি কথা তুলে ধরে শেষ করছি। নিজের যোগ্যতার প্রশ্নে হিরো আলম বলেছেন, ক্রিকেটার মাশরাফি সংসদ সদস্য হয়েছেন। কণ্ঠশিল্পী মমতাজ সংসদ সদস্য হয়েছেন। মাহিয়া মাহি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন। তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস না পেলেও সাংবাদিকরা তাঁর যোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন। অভিনয়শিল্পী সুবর্ণা মুস্তাফা, ক্রিকেটার নাঈমুর রহমান দুর্জয় সংসদ সদস্য। আরিফ খান জয় উপমন্ত্রী ছিলেন। সংসদ সদস্য ছিলেন প্রয়াত চিত্রনায়িকা কবরী। আর হিরো আলম যাঁদের নাম বলেছেন, তাঁরা তো আছেনই। কেউ কেউ আছেন স্বশিক্ষিত। সুতরাং একজন হিরো আলম সংসদে গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। ব্যবসায়ী ও সাবেক আমলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদে হিরো আলম গেলে আইন প্রণয়নে অপূর্ণতা দেখা দেবে না।