পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা ঋণের ছক


আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বাজেটে প্রাথমিকভাবে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর বড় অংশই নেওয়া হবে ব্যাংক খাত থেকে। যার অঙ্ক দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি। পাশাপাশি সোয়া লাখ কোটি টাকার ওপরে (১১৭০ কোটি মার্কিন ডলার) বিদেশি ঋণ নেওয়া হবে। বিপুল অঙ্কের এ ঋণের সুদ পরিশোধে গুনতে হচ্ছে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা চলতি অর্থবছরে ধরা হয়েছে ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। তবে এবারই প্রথম কোনো টাকা ধার নেওয়া হবে না সঞ্চয়পত্র থেকে। আইএমএফ-এর শর্ত পূরণ করতে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের লাগাম টানা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক এই দাতা সংস্থা বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের যে ঋণ দিয়েছে, এর বিপরীতে সঞ্চয়পত্র থেকে ধার কমিয়ে আনার শর্ত জুড়ে দেয়। এখন সে পথেই হাঁটছে সরকার। দেশি ও বিদেশি উল্লিখিত ঋণের রূপরেখার ঘোষণা থাকছে আগামী বাজেটে। সম্প্রতি এর অনুমোদন দেওয়া হয় আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিয়ম হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। এর আগে নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই আবুল হাসান মাহমুদ আলী ‘দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা’ করতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। সেখানে সরকারের ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। বিশেষ করে ঋণ পরিশোধের চাপ প্রসঙ্গে ওই বৈঠকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী বলেন, ‘রাশিয়া থেকে গৃহীত ঋণ এবং মেগা প্রকল্পের বৃহৎ ঋণ পরিশোধের জন্য নির্ধারিত থাকায় ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধের অঙ্ক বৃদ্ধি পাবে। সেই অর্থবছরে ৫৩ কোটি ১০ লাখ ডলার পরিশোধ করার কথা রয়েছে। এরপর ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ৫১ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০২৮-২৯ অর্থবছরে ৫০ কোটি ৭০ লাখ ডলার শোধ করার হিসাব করা হয়েছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলেও ২০৩৪ সালের পর ঋণ পরিশোধের চাপ কমে আসবে।’ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, একটু দেখা দরকার বিগত সময়ে নেওয়া ঋণগুলো কোথায় ব্যবহার হয়েছে। এতে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বর্তমানে না বাড়লেও ভবিষ্যতে বাড়বে কি না, সেটি দেখার বিষয়। তিনি আরও বলেন, সার্বিকভাবে জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাত যা আছে, সেটি খারাপ না। তবে শঙ্কিত না হওয়ার কারণ থাকলেও সতর্কতার সঙ্গে ঋণ নিতে হবে। যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হবে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে নমনীয় (স্বল্প সুদে) ঋণ নেওয়ার। বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ নেওয়াকে আমি নিরুৎসাহিত করছি। কারণ, এসব ঋণ হঠাৎ আসে, আবার চলেও যায় হঠাৎ, এতে চাপ সৃষ্টি করে রিজার্ভের ওপর। এছাড়া তাদের ঋণের শর্ত ও সুদের হার বেশি হয়। সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, সরকারের জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাত প্রায় ২২ শতাংশ। বিশ্বের অনেক দেশে এ অনুপাতের হার ৭০ থেকে ১০০ শতাংশের বেশি আছে। তবে আমাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার বিষয় আছে। আগামী বছর ঋণ ও সুদ মিলে যা পরিশোধ করতে হবে, সেটি আমাদের রেমিট্যান্স ও রপ্তানির মোট আয়ের প্রায় ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশের সমান। এ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এখনো ঋণ গ্রহণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আছে। তবে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারকে সাবধানতা অবলম্বনের কথা যারা বলছেন, তারা ঠিকই বলছেন। অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেসব প্রকল্প নিলে পরিশোধের কোনো বাধা সৃষ্টি হবে না, বিনিয়োগে সহায়তা করবে, সে প্রকল্প বাছাই করে ঋণ নিতে হবে। অন্যথায় যেখানে-সেখানে ঋণ নেওয়া ঠিক হবে না। ঋণ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে তিনি আরও বলেন, বর্তমান মোট ঋণের ৬৩ শতাংশ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নেওয়া, বাকি ৩৩ শতাংশ বিদেশি ঋণ। আর ঋণের উৎসগুলোর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাপান থেকে নেওয়া। এসব সংস্থার ঋণগুলো নমনীয়। এছাড়া ৭ শতাংশ ঋণ চীন, ৬ শতাংশ রাশিয়া, এক শতাংশ ভারত এবং বাকি ঋণ অন্য দেশ থেকেও নেওয়া হচ্ছে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বিদেশি ঋণ নিয়ে এ অস্বস্তি মোকাবিলা করতে হলে এখনই ঋণপ্রবাহ কমিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক শর্তে ঋণ নেওয়া অর্থাৎ সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট কমাতে হবে। এছাড়া ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াতে হলে রাজস্ব আয়, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। তবে বাস্তবতা হলো রপ্তানি নির্ভরশীল হয়ে আছে একটি পণ্যের ওপর, যা অত্যন্ত ঝুঁকির বিষয়। আবার রেমিট্যান্স প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না। অর্থ পাচারের কারণে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। তবে আমরা যদি দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারতাম, তাহলে এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অনেক বাড়ত। জানা যায়, আগামী দুই অর্থবছরে সরকারের বিদেশি ঋণের অঙ্ক আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে বাড়বে পরিশোধের চাপও। একই বছরে অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পাঁচ লাখ ৩১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, নতুন অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের ২০ শতাংশই ব্যয় হবে ঋণ পরিশোধে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত হারে আদায় না বাড়লে বড় ধরনের এ ব্যয় অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আগামী বাজেটের আকার জিডিপির ১৪ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে রাখা হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতির পরিধি অনুযায়ী আকার আরও বড় হওয়া দরকার। সেটি করতে গেলে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাবে। আর ওই ঘাটতি মেটাতে আরও ঋণ করতে হবে। জানা যায়, ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে রয়েছে এবং এর মধ্যেই চলতি বছর থেকেই বড় বড় কিছু প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করাও শুরু হয়েছে। পাশাপাশি রপ্তানি ও রেমিট্যান্সও কাঙ্ক্ষিত আকারে বাড়ানো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ডলারের সরবরাহ না বাড়ানো গেলে বিদেশি ঋণকে ঘিরে সংকট জোরালো হতে পারে-এমন আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, যখন মেগা প্রকল্পগুলোর মূল অর্থ পরিশোধ শুরু হবে, তখন পরিস্থিতি কেমন হয়, তা নিয়েই উদ্বিগ্ন অনেকে। সরকারের হিসাবে বর্তমান ঋণের অনুপাত জিডিপির ৩৭ দশমিক ৩৪ শতাংশের সমান। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবলের (আইএমএফ) মানদণ্ডে একটি দেশ তার মোট জিডিপির ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ গ্রহণের মাত্রাকে ঝুঁকিমুক্ত হিসাবে গণ্য করা হয়। ফলে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, ঋণের মাত্রা এখনো ঝুঁকিমুক্ত আছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিডিপির অনুপাত হারে ঋণ কম হলেও রাজস্ব আয়, রপ্তানি, রেমিট্যান্স বাড়ানো এবং ডলারের মূল্য স্থিতিশীল আনতে না পারলে ঝুঁকির মধ্যে পড়ার শঙ্কা থাকবে। এসব খাতে আয় বৃদ্ধি এবং একই সঙ্গে বিদেশি ঋণের প্রবাহ কমিয়ে না আনতে পারলে বিশাল চাপ তৈরি করতে পারে আগামী কয়েক বছরে। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিদেশি ঋণের স্থিতির অঙ্ক ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৬২ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে ঋণ আছে ৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা।