২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে


এবার ২০২২ সালের যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে চীন। মঙ্গলবার চীনের স্টেট কাউন্সিল ইনফরমেশন অফিস এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। সিনহুয়া। প্রতিবেদনে চীন বলছে, যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে মানবাধিকার রক্ষার উদ্ধারকর্তা হিসাবে নিজেকে দাবি করে সেই যুক্তরাষ্ট্রেই আর্থিক দুর্নীতি, বর্ণবৈষম্য, অস্ত্র এবং পুলিশি সহিংসতাসহ সম্পদ কুক্ষিগত করার ঘটনা অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যক্তি পর্যায়ে অস্ত্র রাখার নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র চরম শৈথিল্য প্রদর্শন করেছে। এর ফলে সেখানে বন্দুক সহিংসতায় হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। বন্দুক নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেকের বেশি স্টেটে শৈথিল্য অবলম্বন করা হয়। বিশ্বে বন্দুকের মালিকানা, বন্দুককেন্দ্রিক হত্যাকাণ্ড এবং এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যার ঘটনার দিক দিয়েও যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে অবস্থান করছে। ২০২২ সালে এসব ঘটনায় ৮০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০টির বেশি ‘ম্যাস শুটিং’য়ের ঘটনা ঘটেছে। বন্দুককেন্দ্রিক সহিংসতা ‘যুক্তরাষ্ট্রের মহামারি’তে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন সবচেয়ে ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। আর আমেরিকান ধাঁচের গণতন্ত্রও এর জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ক্রমবর্ধমান ব্যয় ১৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। নির্বাচনের সময় বিলিয়নিয়ারদের কাছ থেকে অনুদান নেওয়াও বেড়েছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের মোট ব্যয়ের ১৫ শতাংশ এখান থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০২০ নির্বাচনের সময় এ অর্থের পরিমাণ ছিল ১১ শতাংশ। এই ‘ডার্ক মানি’ অনুদান মার্কিন নির্বাচনকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। এর ফলে নির্বাচনের কৌশলে কারসাজি, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং সামাজিক বিভক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক ঐকমত্যে পৌঁছানো কঠিন করে তুলেছে। ৬৯ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন যে তাদের গণতন্ত্র পতনের ঝুঁকিতে রয়েছে এবং ৮৬ শতাংশ আমেরিকান ভোটার মনে করেন মার্কিন গণতন্ত্র মারাত্মক হুমকিতে রয়েছে। আমেরিকান-স্টাইলের গণতন্ত্রের প্রতি এখন সাধারণ জনগণের মোহভঙ্গ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বাড়ছে এবং জাতিগত সংখ্যালঘুরা সেখানে ব্যাপকভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ২০২০ থেকে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে হিংসাত্মক অপরাধ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাফেলো সুপারমার্কেটে ১০ জন আফ্রিকান-আমেরিকানের বর্ণবাদী গণহত্যা বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৮১ শতাংশ এশিয়ান আমেরিকান বলেছেন যে এশীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়ছে। শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় পুলিশের হাতে আফ্রিকান আমেরিকানদের নিহত হওয়ার আশঙ্কা ২ দশমিক ৭৮ গুণ বেশি। ভারতীয় এবং অন্যান্য আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের গৃহীত গণহত্যা এবং সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের ফলে সৃষ্ট ভোগান্তি এখনো অব্যাহত রয়েছে। চীন প্রতিবেদনে বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের গড় আয়ু কমে গেছে। মাদকের অপব্যবহারের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা সেখানে বেড়েই চলেছে। ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের অধীনে ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটিস্টিকসের আগস্ট ২০২২-এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গড় আয়ু ২ দশমিক ৭ বছর কমে ৭৬ দশমিক ১ বছরে নেমে এসেছে, যা ১৯৯৬ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন। স্বার্থান্বেষীগোষ্ঠী এবং রাজনীতিবিদরা অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতা জাহির করে, মাদকের অপব্যবহার বৃদ্ধি পেতে সহায়তা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদকের অপব্যবহারে আমেরিকানদের মৃত্যুর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। এ কারণে প্রতিবছর আমেরিকাতে ১০০,০০০-এরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। মাদকের অপব্যবহার আমেরিকার জন্য অন্যতম ভয়বহ জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে। নারীদের গর্ভপাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে সাংবিধানিক যে সুরক্ষা ছিল সেটা তারা হারিয়েছেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র শিশুদের বসবাসের পরিবেশ বেশ উদ্বেগজনক। মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের রায় রো বনাম ওয়ডেকে বাতিল করে প্রায় ৫০ বছর ধরে মার্কিন সংবিধানে সুরক্ষিত মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকার নিঃশেষ করেছে, যা নারীর মানবাধিকার এবং লিঙ্গ সমতার জন্য একটি বড় আঘাত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে, ১৮ বছরের কম বয়সি ৫৮০০টিরও বেশি শিশুকে গুলি করে আহত বা হত্যা করা হয়েছে এবং স্কুলে গুলি চালানোর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০২টিতে। এ সংখ্যা ছিল ১৯৭০ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ। যুক্তরাষ্ট্রে শিশু দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বেড়েছে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ১৬ দশমিক ৬ শতাংশে, ২০২২ সালের মে মাসে, আরও ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন শিশু দারিদ্র্যের মধ্যে চলে গেছে। ২০১৮ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শিশু শ্রম লঙ্ঘনের ঘটনা প্রায় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২২ অর্থবছরে বিপজ্জনক পেশায় নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন শক্তির অপব্যবহার এবং একতরফা নিষেধাজ্ঞা বিশ্বে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ২১ শতকের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস বিরোধিতার নামে ৮৫টি দেশে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এর ফলে কমপক্ষে ৯ লাখ ২৯ হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৩৮ মিলিয়ন মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র বেশি একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখনো ২০টিরও বেশি দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। যার ফলে সেসব দেশের জনগণ মৌলিক খাদ্য এবং ওষুধ সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঔপনিবেশিকতা, বর্ণবাদী দাসত্ব এবং শ্রম, দখল ও বণ্টনের অসমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক বণ্টন প্যাটার্নের মিথস্ক্রিয়ায় সিস্টেমের ব্যর্থতা, শাসনের ঘাটতি, জাতিগত বিভাজনের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। চীন বলছে, আমেরিকান রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে কাজ করেন। এর ফলে তারা ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রতি সাড়া দেওয়া এবং সাধারণ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার ইচ্ছা এবং বস্তুনিষ্ঠ ক্ষমতা হারিয়েছেন এবং মানবাধিকারের নিজস্ব কাঠামোগত নানা সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা মানবাধিকারকে অন্য দেশগুলোতে আক্রমণ করার জন্য একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে সংঘাত, বিভাজন এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং এইভাবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী এবং এর রক্ষায় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।