সংগঠনের টাকা মেরে কোটিপতি মাহাতাব


এক দশক ধরে রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব হোসেন চৌধুরী। সম্পাদক হওয়ার পরে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শ্রমিক ইউনিয়নের অর্থ লুটপাট করে হয়েছেন ১০টি বাসের মালিক। বাস মালিক হয়েও তিনি শ্রমিকনেতা। থাকেন পাঁচতলা বাড়িতে। আরেকটি ১০ তলা অট্টালিকা নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। চড়েন অর্ধকোটি টাকা মূল্যের ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িতে। দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিক ইউনিয়নকে দেননি আয়-ব্যয়ের হিসাব। রয়েছে অডিট আপত্তি। অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির মাধ্যমে মাহাতাব গড়েছেন অঢেল সম্পদ। অভিযোগ উঠেছে, শ্রমিক ইউনিয়নের নতুন সদস্য কার্ড বিক্রি, জমি বিক্রি, দুই তলা ভবন বিক্রি, বিভিন্ন পরিবহণ থেকে দৈনিক চাঁদা আদায়, দুটি শাখা কার্যালয় বিক্রিসহ বিভিন্ন খাত থেকে মাহাতাব এ বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। রাজশাহীর নওদাপাড়া বাস টার্মিনালে শ্রমিকদের উন্নয়নের কথা বলে মেলার আয়োজন করে আত্মসাৎ করেছেন কয়েক কোটি টাকা। শিরোইল বাস টার্মিনালে চলে জুয়ার আসর। এখান থেকেও মাহাতাবের পকেটে ঢুকছে প্রতিরাতে লক্ষাধিক টাকা। তার পাহাড়সম দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ সম্প্রতি কাছে এসেছে। এছাড়া শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকেও বঞ্চিত করেছেন মাহাতাব। দেননি মৃত্যুকালীন ও কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার অনুদান, শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ভাতা, শ্রমিকনেতাদের সম্মানি এবং কর্মচারীদের বেতনভাতা। এর মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় মাহাতাবের বিরুদ্ধে রাজশাহী শ্রম আদালতে রয়েছে একাধিক মামলা। রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম তিন বছরের জন্য সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মাহাতাব। এরপর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি। ইউনিয়নে তৈরি করেন একক আধিপত্য। নিয়ন্ত্রণ নেন সবকিছুর। পাশাপাশি ঘটে তার রাজনৈতিক উত্থান। এ সময় মাহাতাব রাজশাহী মহানগরীর ২৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদটি বাগিয়ে নেন। এরপর ওই বছরেই রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। দলের শীর্ষ এক নেতাকে ম্যানেজ করে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদকের পদটিও দখলে নেন তিনি। ১০টি যাত্রীবাহী বাসের মালিক মাহাতাব। এর মধ্যে চারটি বাস স্ত্রীর নামে রয়েছে। বাকিগুলোর মালিক মাহাতাব হলেও সেগুলো বিভিন্ন নামে-বেনামে চলছে। এসব বাসের আনুমানিক মূল্য চার কোটি টাকা। রাজশাহীর অন্য বাস মালিকরা একদিন পরপর রাস্তায় চলার (রুট পারমিট) অনুমতি পান। কিন্তু মাহাতাবের বাস এ নিয়মের মধ্যে নেই। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দাপটে তার বাস উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে প্রতিদিনই চলাচল করে। মাহাতাব মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা টিকাপাড়ায় তৈরি করেছেন পাঁচতলা বাড়ি। বর্তমান বাজারে এ বাড়ির দাম আনুমানিক পাঁচ কোটি টাকা। পাশেই নির্মাণ পরিকল্পনায় রয়েছে ‘শ্রাবন্তী টাওয়ার’ নামে আরেকটি ১০তলা বাড়ি। জমির সামনে ঝুলছে সাইনবোর্ড। এ বাড়িটি নির্মাণ করতে ব্যয় হবে আনুমানিক ১০ কোটি টাকা। জানা যায়, মহানগরীর উপকণ্ঠ খড়খড়ি এলাকায় ললিতাহার মৌজায় ইউনিয়নের ১৬ কাঠা জমি বিক্রি করে দিয়েছেন মাহাতাব। জমিটি ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। শিরোইল বাস টার্মিনাল সংলগ্ন দ্বিতীয় তলা ভবন বিক্রি করে ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন মাহাতাব। শ্রমিকদের কার্ড বিক্রির এক কোটি টাকারও হিসাব দেননি তিনি। এছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন পরিবহণ থেকে দৈনিক আয় হয় ৫০ হাজার টাকা। এরও কোনো হিসাব নেই। শুধু এ খাত থেকে মাহাতাব প্রতিমাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। জেলার বাঘা এবং গোদাগাড়ী শাখা কার্যালয় সাত লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। সেই টাকারও হিসাব দেননি। মাহাতাব শ্রমিকদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করছেন না। প্রায় একশ শ্রমিকের মৃত্যুকালীন অনুদানেরর টাকা বকেয়া রয়েছে। এর পরিমাণ প্রায় ৮০ লাখ টাকা। দীর্ঘ সময়েও মৃত শ্রমিকদের পরিবারের লোকজন এসব টাকা পাননি। কন্যাদায়গ্রস্ত শ্রমিকের সংখ্যা রয়েছে প্রায় আড়াইশ। প্রত্যেক কন্যাদায়গ্রস্তকে শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে ৪০ হাজার টাকা করে পাওয়ার নিয়ম রয়েছে। এ হিসাবে এক কোটি টাকা আটকে রেখেছেন মাহাতাব। রয়েছে শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ভাতার টাকাও। প্রতি শ্রমিক তাদের সন্তানদের জন্য ২০ হাজার টাকা করে শিক্ষা ভাতা পাওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও বঞ্চিত হয়েছেন তারা। ৫০ শিক্ষার্থীর ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন মাহাতাব। এছাড়া শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মচারী ও নেতাদের নয় মাসের আড়াই কোটি টাকা সম্মানি বকেয়া রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকের দুই বছর পর্যন্ত সম্মানি আটকে রেখেছেন মাহাতাব। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মাহাতাব প্রথম দফায় সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে চাটার্ড অ্যাকাউন্ট ফার্ম আনিসুর রহমান অ্যান্ড কোংয়ের নিরীক্ষায় ১ কোটি ৮১ লাখ ৭ হাজার ৪৬৬ টাকা অডিট আপত্তি ধরা পড়ে। আজও এর নিষ্পত্তি হয়নি। অডিটে শিরোইল টার্মিনালসংলগ্ন জমিসহ দ্বিতীয় তলা ভবন বিক্রির ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। একই অডিটে সদস্য চাঁদার ৪ লাখ ৭৫ হাজার ১৬০ টাকা ক্যাশবুকে আয় হিসাবে দেখানো হয়নি। এছাড়া বিভিন্ন খাতে আরও অনিয়ম ধরা পড়েছে। রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ জহুরুল ইসলাম জনি বলেন, গত বছরের ৮ জুন মাহাতাব চৌধুরীর অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করায় আমাকে আর ইউনিয়ন কার্যালয়ে ঢুকতে দেন না। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তিনি ১০টি বাসের মালিক। এর প্রমাণ আমার কাছে আছে। মাহাতাব যে টাকা আত্মসাৎ করছেন, তা ইউনিয়নকে ফেরত দিতে হবে। আমি তার বিচার দাবি করছি। শ্রমিক ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক পরিমল দাস বলেন, চিকিৎসার অভাবে ইউনিয়নের সহসভাপতি মুকুল আলী এবং সহসম্পাদক আবুল কালাম আজাদসহ কয়েকজন শ্রমিক মার গেছেন। এখনো অনেকে অসুস্থ। এরপরও মাহাতাব ইউনিয়নের ফান্ড থেকে টাকা দিচ্ছেন না। এসবের প্রতিবাদ করায় আমাদের মারধর এবং লাঞ্ছিত করা হয়েছে। আমরা অবিলম্বে এসবের প্রতিকার চাই। অভিযোগ অস্বীকার করে মাহাতাব বলেন, ইউনিয়নের জমি বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ সঠিক নয়। এ টাকা ২ হাজার ৪৪০ জন শেয়ারহোল্ডারের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। শ্রমিকদের কার্ড বিক্রি করেও টাকা আত্মসাৎ করা হয়নি। আর বাস থেকে প্রতিদিনের চাঁদা উত্তোলনের টাকা বিভাগীয় এবং আঞ্চলিক মিটিংগুলোয় ব্যয় করা হয়। মৃত্যুকালীন অনুদান, শিক্ষা ভাতা এবং অন্যান্য অনুদানের অর্থও আত্মসাতের অভিযোগ ভিত্তিহীন। বরং আমিই ইউনিয়নের কাছে টাকা পাব। মাহাতাব বলেন, জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগও মিথ্যা। কাউকে মারধর বা হুমকিও দিইনি। আমার ১০টি না, ৪টি বাস আছে। এগুলো কিনতে আমার বোন টাকা দিয়েছেন। এছাড়া ব্যাংকেও লোন আছে। আর যে গাড়িটিতে আমি চড়ি, সেটির মালিকানা আমার নামে নেই। তবে অডিট আপত্তির বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।