দশ মিনিটের দেরিতে ২৪ ঘণ্টার ভোগান্তি


মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিকস ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) আসেন মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের আসাদুজ্জামান (৩০)। গুরুতর আহত হওয়ায় চিকিৎসকরা এক্সরে রিপোর্ট দেখেই ভর্তি নেন। একই সঙ্গে হার্টের ইসিজি ও ইকো কার্ডিওগ্রাম পরীক্ষার পরামর্শ দেন। আসাদুজ্জামানের বাবা ইদ্রিস মিয়া বুধবার দুপুর ১টা ১০ মিনিটে হাসপাতালের বহির্বিভাগের বিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিকস ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) আসেন মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের আসাদুজ্জামান (৩০)। গুরুতর আহত হওয়ায় চিকিৎসকরা এক্সরে রিপোর্ট দেখেই ভর্তি নেন। একই সঙ্গে হার্টের ইসিজি ও ইকো কার্ডিওগ্রাম পরীক্ষার পরামর্শ দেন। আসাদুজ্জামানের বাবা ইদ্রিস মিয়া বুধবার দুপুর ১টা ১০ মিনিটে হাসপাতালের বহির্বিভাগের বিল কাউন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি জমা দিতে আসেন। কিন্তু তাকে জানানো হয় ১টার পর ফি নেওয়া হয় না। পরীক্ষা করাতে চাইলে পরদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দিতে হবে। তবেই টেস্ট করাতে পারবেন। এ সময় ইদ্রিস মিয়ার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, ‘বাইক এক্সিডেন্টে ছেলের হাঁটুর নিচে ভেঙে গেছে। এখানে আনার পর ইমার্জেন্সি বিভাগে শুধু এক্সরে করাতে পারছি। পরে পুরাতন ভবনের ১নং ওয়ার্ডের ভর্তি করেছি। সিট ফাঁকা না থাকায় মেঝেতেই বিছানা পেতেছি। তিনি আরও জানান, ছেলের শারীরিক পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় সকাল থেকে চিকিৎসক-নার্সদের পেছনে দৌড়ানোসহ ওষুধ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতেই সময় চলে গেছে। এখন এসেছেন টাকা জমা দিতে। কাউন্টার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন আগামীকাল সকাল ৮টার পর আসতে। তিনি আক্ষেপ করে করে বলেন, পকেটের অবস্থাও ভালো নয়, যে চাইলেই বেসরকারিভাবে পরীক্ষা করাব। মাত্র ১০ মিনিট দেরি হওয়ায় আগামীকাল অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার জন্য ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এক হাজার শয্যার হাসপাতালে কাউন্টার খোলা থাকে মাত্র কয়েক ঘণ্টা! রিপোর্টও দ্রুত পাওয়া যায় না। হাসপাতালের ইএফ/জি ওয়ার্ডের ৬২-নং বিছানায় ভর্তি আছেন মুস্তফা (৩৮)। চিকিৎসক দুই ব্যাগ রক্ত দিতে বলেছেন। মুস্তাফার রক্তের সঙ্গে রক্তদাতার (ব্লাড ডোনার) রক্তের ক্রস ম্যাচিংয়ের জন্য তার ভাই নাজমুল দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে কাউন্টারে টাকা জমা দিতে আসেন। তাকেও পরদিন আসতে বলা হয়। নাজমুল কাছে অভিযোগ করেন, অনেক কষ্টে দুজন ডোনার ম্যানেজ করছেন। তারা দীর্ঘ যানজট ঠেলে রক্ত দিতে এসেছেন। কয়েক মিনিট দেরি হওয়ায় আগামীকাল আসতে বলা হচ্ছে। কিন্তু ডোনার তো আর কাল-পরশু বুঝবে না। ২৪ ঘণ্টা ল্যাব খোলা না থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। সরেজমিন পঙ্গু হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে সেখানে পুরুষ রোগীদের জন্য ৩টি এবং নারীদের জন্য একটি বিল কাউন্টার দেখা যায়। দুপুর ১টার পর কারও টাকা জমা নেওয়া হচ্ছে না। বুধবার দুপুর ১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত কাউন্টারে সামনে অবস্থান করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফি জমা দিতে এসে অন্তত ২০ জন রোগীর অভিভাবককে নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে দেখা গেছে। এছাড়া বহির্বিভাগে চিকিৎসক দেখাতে আসা শতাধিক রোগীকে গরমে হাঁসফাঁস করতে দেখা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান এখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি (এসি) দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। কোনো ফ্যানও লাগানো হয়নি। এক্সরে কক্ষের বাইরে রোগীদের বসার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক চেয়ার নেই। সেখানেও কোনো এসি বা ফ্যান নেই। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, এক হাজার শয্যার হাসপাতালটিতে দৈনিক ১২০০ থেকে ১৩০০ রোগী ভর্তি থাকে। প্রতিদিন জরুরি ও বহির্বিভাগে অসংখ্য রোগী আসে। সব রোগীই বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আসে। যাদের বেশিরভাগই অন্যের সহযোগিতা ছাড়া স্বাভাবিক চলাফেরা পর্যন্ত করতে পারে না। রোগীদের বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার হয়। সেবা পরিধি বাড়াতে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সময় বৈকালিক সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি। অথচ পাশেই জাতীয় নিউরোসায়েন্স, জাতীয় হৃদরোগ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শিশু হাসপাতালে বৈকালিক সার্ভিস চালু করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক ল্যাব চালু রয়েছে। কিন্তু পঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টা ল্যাব সুবিধা না থাকায় হাসপাতাল ঘিরে একটি দালাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি ডায়াগনস্টিকে নিচ্ছেন। দালালের খপ্পরে পড়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। ল্যাব সংশ্লিষ্টরা জানান, পঙ্গু হাসপাতালের ল্যাবে প্রায় একশ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। দৈনিক গড়ে ১২০০ রোগী পরীক্ষার জন্য আসেন। অত্যাধুনিক মেশিনে ডিজিটাল রিপোর্ট দেওয়া হয়। রোগীরা বাইরে তুলনায় খুবই কম খরচে পরীক্ষা করাতে পারেন। যেমন; ভিটামিন ডি টেস্ট ২৫০০ টাকা। বাইরে খরচ হয় ৬ হাজার টাকা। সিটি স্ক্যানের জন্য দুই হাজার এবং এমআরআই এর জন্য ২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৪ হাজার টাকা খরচ লাগে। বাইরে খরচ অনেক বেশি। তারা আরও বলেন, রোগীদের জরুরি টেস্টের ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু জরুরি বিভাগে এক্সরে ছাড়া কোনো পরীক্ষাই ২৪ ঘণ্টা চালু নেই। বহির্বিভাগে দুপুর সাড়ে ১২টার পর এক্সরে পরীক্ষার টাকা জমা নেওয়া হয় না। ফিল্ম সংকটে বহির্বিভাগের এক্সরে প্রায়ই বন্ধ থাকে। প্রায় তিন বছর ধরে এমআরআই মেশিন নষ্ট। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু করা হলে রাজস্ব আয় বাড়বে। হাসপাতাল সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায় বুধবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৯৪১ জন পরীক্ষার জন্য টাকা জমা দিয়েছে। টিকিট বিক্রির বাইরে গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ রোগীদের কাছ থেকে ৬ লাখ ৭২ হাজার ২৫০ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। আগস্ট মাসে রাজস্ব আয় হয়েছিল (টিকিট বিক্রি ছাড়া) ১ কোটি ৩৩ লাখ ২৩ হাজার ২৭৫ টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিল কাউন্টারের একজন কর্মী বলেন, বহির্বিভাগের চারটি বিল কাউন্টারে টেস্টের টাকা জমা নেওয়া হয়। জনবল মাত্র ছয়জন। কাউন্টার ইনচার্জ ছাড়া পাঁচজনই আউট সোর্সিং কর্মী। গত জুলাই মাসে আউটসোর্সিং কর্মীদের প্রকল্প মেয়াদ শেষ হয়েছে। এক্সটেনশন (বর্ধিতকরণ) না হওয়ায় গত দুই মাস ধরে ৩৪১ জন কর্মী বেতন পাচ্ছে না। জনবল সংকট কমাতে ২০১৮ সালে সাবেক পরিচালক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছিলেন। অজানা কারণে সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি। এসব বিষয়ে পঙ্গু হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান ডা. জোহরা আজিজের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৈকালিক সার্ভিস চালুর বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরে আর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। জনবল সংকটও রয়েছে। আর সার্বক্ষণিক টেস্ট চালুর বিষয়টি হাসপাতালের প্রশাসনিক বিভাগ ভালো বলতে পারবেন। পরে চেষ্টা করেও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামিমুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। তার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।