রাজধানী যেন এখন দাবির শহর
অনলাইন নিউজ ডেক্স
ইট-পাথরের শহর রাজধানী ঢাকা কার্যত এখন আন্দোলনের শহরে পরিণত হয়েছে। নানা দাবিতে কথায় কথায় চলছে রাজপথ অবরোধ। কোথাও কোথাও অগ্নিসংযোগসহ সংঘাত-সহিংসতার ঘটনাও এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এতে কার্যত অবরুদ্ধ এই শহরের মানুষ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিরাপত্তাহীনতার ফিরিস্তি। কথা নেই, বলা নেই- হঠাৎ উৎকণ্ঠার ছাপ এসে ভর করেছে নগরবাসীর জীবনে। কখন কোথায় কী ঘটবে-তা জানা নেই কারও। ছোটখাটো ঘটনা নিয়েই তৈরি হচ্ছে সংঘাত কিংবা সহিংসতা। দাবি আদায়ের মতো স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠছে সহিংস। কোনোভাবেই অস্বাভাবিক এসব ঘটনার লাগাম টানা যাচ্ছে না। ফলে ভোগান্তির শেষ নেই কারও।
ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেন। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে টানা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসানের পর নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ৮ আগস্ট তার নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। একই সঙ্গে সূচিত হয় সাধারণ মানুষের পাহাড়সম প্রত্যাশাও। শান্তির পথে, উন্নয়নের পথে, গণতন্ত্রের পথের এই যাত্রায় মানুষ ফিরে পাবে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং সামাজিক মর্যাদা। বিনাবিচারে হত্যা, খুন-গুম-অপহরণের অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটবে চিরতরে, মিলবে ভোটের অধিকার-এমনটাই এখন সবার চাওয়া।
কিন্তু এই চাওয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নানা পক্ষ। ৫ আগস্টের পর যেন কোনোভাবেই স্থায়ীভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছে না রাজধানী ঢাকা। যে কোনো ইস্যু নিয়েই হচ্ছে আন্দোলন। অনেকেই তাদের দাবি নিয়ে সচিবালয় এলাকা এবং মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ‘যমুনা’র সামনে অবস্থান নেন। কখনো আনসার, কখনো প্যাডেলচালিত রিকশার চালক, কখনো ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক, কখনো গার্মেন্ট শ্রমিক, কখনো শিক্ষক-চিকিৎসক-নার্স, কখনো সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের চাকরিজীবী, কখনো পল্লী বিদ্যুতের কর্মচারী, শিক্ষার্থী-নাট্যকর্মীসহ পেশাজীবীরা, আবার কখনো চাকরিতে ৩৫ বয়স প্রত্যাশীরা রাস্তায় নেমে পড়েছেন। নানা দাবিকে ঘিরে কমবেশি প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে খণ্ড খণ্ড আন্দোলন। এর মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকা যেন হয়ে উঠেছে দাবি আদায়ের আন্দোলনের শহর।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ সোমবার বলেন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে জানাতে পারেনি। কেউ যদি দাবি-দাওয়া জানাতে রাস্তায় নামতে চাইত, সেখানেও বাধা দেওয়া হয়েছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সুযোগ নিয়ে এখন তারা তাদের মতো করে মাঠে নামছে। তাদের এই মাঠে নামাটা অযৌক্তিক নয়। তবে দাবি আদায়ের নামে সংঘাত-সহিংসতা, সড়ক অবরোধ এবং এর ফলে জনদুর্ভোগ তৈরি করাটা দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকারেরও এখানে কিছুটা দায় আছে। তাদের উচিত আলাপ-আলোচনার পথ খোলা রেখে সমস্যা সমাধানে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া। মানুষের দুঃখ-কষ্ট বুঝতে হবে। সবকিছু আদালতের দিকে না গিয়ে নিজেরাও সমাধানের পথ বাতলে নিলে এই অরাজকতা থাকবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমান সরকারের কাছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের চাওয়া-পাওয়া থাকা স্বাভাবিক। তবে শুরুতেই অতিরিক্ত আন্দোলন হলে সেটি আবার সরকারের জন্যই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এ সময় ছাত্র-জনতা এবং সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সব ধরনের অনিয়ম, অন্যায় ও বৈষম্য দূর করা উচিত।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান এ প্রসঙ্গে বলেন, যারা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছেন তাদের দাবির যৌক্তিকতা আছে। গত ১৫ বছরে অনেক বৈষম্য এবং অনিয়মের কারণে অনেকেই বঞ্চিত হয়েছে। তারা মনে করছেন, এখনই সময় এই বৈষম্য অবসানের। কিন্তু তারা এই দাবি জানাতে গিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পথে না গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করছেন। সচিবালয়ে ঢুকে পড়ছেন, ঘেরাও করছেন, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে বসে পড়ছেন। ঢাকার রাস্তা দখল করে আন্দোলন করতে গিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছেন, যা দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, সব দাবি সরকার একবারে পূরণ করতে পারবে না। আর যারা তাদের দাবি তুলছেন তাদেরও বিবেচনা করতে হবে যে, সরকার এখনই সব যৌক্তিক দাবি পূরণ করতে পারবে কিনা। তাই উভয় পক্ষকেই সহনশীল হতে হবে।
সম্প্রতি ঢাকা কলেজ এবং সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজকে ঘিরে রণক্ষেত্র তৈরি হয়েছে যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া এলাকা। মাত্র একদিন আগে বুটেক্সের আজিজ হল ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের লতিফ হলের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়, ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। কয়েকদিন ধরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক ও মালিকরা বিভিন্ন দাবি আদায়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ও সমাবেশ করছে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে যায় তারা। পরে পুলিশ প্রশাসনের আশ্বাসে গণ-অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়ন। যদিও সোমবার ব্যাটারিচালিত যানবাহন বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে ফের সড়ক অবরোধ করে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভে নামেন তারা।
শুধু তাই নয়, ঢাকায় বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ওয়াসা, ডেসা, সচিবালয় কর্মচারী থেকে বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তাদের দাবি নিয়ে মাঠে আছেন। তাদের প্রধান অসন্তোষের কারণ পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়া, চাকরি স্থায়ী না করা। আবার যারা বিভিন্ন সময় চাকরিচ্যুত হয়েছেন তারাও চাকরি ফিরে পেতে মাঠে নেমেছেন। দাবি আদায়ে মাঠে আছেন গ্রামপুলিশরাও। আন্দোলনে আছেন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরাও। দাবি আদায়ে আর কেউ সফল না হলেও শিক্ষার্থীদের একাংশ পুরোপুরি সফল। আন্দোলন করে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার অবশিষ্ট ছয় বিষয়ের পরীক্ষা ইতোমধ্যে বাতিল করে নিয়েছেন তারা। গত ২০ আগস্ট একযোগে সচিবালয়ে ঢুকে শিক্ষা উপদেষ্টাকে ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি আদায় করে নেয়। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন বেতন কমানোর আন্দোলন চলছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, টানা ১৫ বছরেরও বেশি ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ন ও পদোন্নতি বঞ্চনা, যৌক্তিক নিয়োগ নীতিমালা তৈরি না করা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ঠিক না করেই ইচ্ছামতো দলীয় লোক নিয়োগ দিয়ে বৈষম্যের পাহাড় তৈরি করেছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তাই এখন বঞ্চিতরা অধিকার আদায়ে মাঠে নেমেছেন। এ আন্দোলন প্রশাসনের হৃৎপিণ্ড বাংলাদেশ সচিবালয় থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের সরকারি দপ্তর ও সংস্থা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এ সুযোগে দাবি পূরণের তালিকায় অতীতে দুর্নীতির দায়ে পদোন্নতিবঞ্চিতরাও ঢুকে পড়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবশ্য আন্দোলনকারীদের যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণের দিকে হাঁটছেন বলে জানা গেছে। এজন্য আন্দোলনকারীদের কথাগুলো মনোযোগ দিয়েও শুনছেন সরকারের উপদেষ্টারা।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।