লুট হচ্ছে পদ্মার মাটি, অসহায় প্রশাসন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা সদরে ইজারা ছাড়াই পদ্মার মাটি লুটে নেওয়া হচ্ছে। বড়ালের উৎসমুখে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রায় সাত মাস প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে মাটিকাটার এ মহাযজ্ঞ। প্রশাসন বলছে, তারা অসহায়। মাটিকাটা বন্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে স্থানীয় প্রশাসন এক পর্যায়ে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। অভিযানের প্রতিবাদে ইউএনও’র বাসভবনে হামলাও করা হয়। ভূমি অফিসের কর্মচারীদের দেওয়া হচ্ছে হুমকি। পুলিশের বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।উপজেলা সদর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদীর তীরে দিনরাত মাটিকাটার কাজ চলছে। দিনে অন্তত শতাধিক ট্রাক মাটি সরানো হচ্ছে। কাজটি নির্বিঘ্নে করতে সেখানে সশস্ত্র পাহারায় রয়েছে বিএনপির একটি অংশের নেতাকর্মীরা। স্থানীয়রা সাহস পাচ্ছেন না প্রতিবাদ করার। মাটি তোলা বন্ধে বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এবং পনি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এসএম মিজানুর রহমান গত ১৫ এপ্রিল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।মাটিকাটার স্থানটির তিনশ মিটারের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি এবং দুইশ মিটারের মধ্যে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের দুটি সীমান্ত ফাঁড়ি (বিওপি)। এই বালুমহালের পাঁচশ মিটার দূরেই রয়েছে চারঘাট থানা, উপজেলা ক্যাম্পাস, উপজেলা ভূমি অফিস এবং কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি বিবেচনায় তিন বছর আগেই চারঘাট মৌজার এ বালুমহালটি ইজারা বন্ধ করা হয়।জেলা পরিষদ ডাক বাংলোর পাশ দিয়ে বড়াল নদের তীর ধরে একটি রাস্তা সোজা চলে গেছে পদ্মা নদীর তীরে। একের পর এক ড্রামট্রাক নদী থেকে উঠে আসছে মাটি নিয়ে। যেখানে মাটিকাটা হচ্ছে সেই জায়গাটি বড়াল নদীর উৎসমুখ। মাটি কাটতে কাটতে স্থানটি প্রায় ২০ ফুট পর্যন্ত গভীর করে ফেলা হয়েছে। সেখানে টিনের একটি ঘর রয়েছে। প্রতিবেদককে দেখার পর তিন ব্যক্তি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এ প্রতিবেদককে ঘিরে ধরেন। এদের একজন চারঘাট পৌর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান সান্টু। ছিলেন স্থানীয় ছাত্রদল নেতা মো. ওয়াসিম এবং তাদের আরেক সহযোগী জরিব হোসেন।সান্টু জানান, তীর থেকে তারা শুধু ভরাট মাটি কেটে বিক্রি করছেন। প্রতি ট্রাক মাটি বিক্রি করছেন ৫ হাজার টাকায়। ট্রাক চলাচলের রাস্তা ঠিক করার কাজে নিযুক্ত শ্রমিক এতিমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, দিনেরাতে শতাধিক ট্রাকে মাটি ওঠে। বেশি ওঠে রাতে। দিনে অন্তত ৫ লাখ টাকা লুটে নিচ্ছেন বিএনপি নেতারা।নেপথ্যে বিএনপি নেতারা: পৌর ছাত্রদলের নেতা সান্টু জানান, বালুমহালের মালিক মতলেব ভাই। মতলেব উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। তার সঙ্গে আছেন উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুরাদ পাশা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক জহুরুল হক জীবনও। জানা গেছে, মতলেবের নামে বিভিন্ন থানায় অস্ত্র, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও মাদকের ১২টি মামলা রয়েছে। ৫ আগস্টের পর তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। স্থানীয়রা বলছেন, বিএনপির আরেক গ্রুপ ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। তাদের প্রতিহত করতে ঘাটে গড়ে তোলা হয়েছে অস্ত্রের মজুত। ভয়ে এলাকার লোকজন নদী তীরের দিকে যান না। অসহায় হয়ে পড়েছে প্রশাসনও। বাইরে থেকে কেউ সেদিকে গেলে পড়তে হয় জেরার মুখে।হুমকির মুখে পুরো এলাকা : তিন বছর আগেও এই বালুমহাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ইজারা দেওয়া হতো। কিন্তু পুলিশ একাডেমি, উপজেলা ক্যাম্পাসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হুমকির মুখে পড়ায় ইজারা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সবশেষ গত বছরের ৪ ডিসেম্বর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেন চারঘাট উপজেলার বালুমহালের বাস্তব অবস্থার তদন্ত প্রতিবেদন দেন।এতেও বালুমহালটি ইজারা না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।পুলিশ চুপ, অসহায় প্রশাসন: গত বছরের সেপ্টেম্বরে অবৈধভাবে বালুমহালটি চালু করা হয়। প্রশাসন কয়েকদফা উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়। সূত্র বলছে, বালুমহাল থেকে প্রতি সপ্তাহেই থানায় টাকা যাচ্ছে।জানা গেছে, খবর পেয়ে তৎকালীন ইউএনও সানজিদা সুলতানা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেন সরেজমিনে পরিদর্শনে যান। কিন্তু লোকজনের সশস্ত্র অবস্থান দেখে তারা ফিরে আসেন। এরপর ২১ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে ইউএনও সেনাবাহিনীর একটি টহল দলকে সেখানে পাঠান। সেদিন সেনাবাহিনী মাটিকাটা বন্ধ করে আসলেও পরদিন সন্ধ্যা সাতটার দিকে মতলেব থানায় গিয়ে তৎকালীন ওসি আফজাল হোসেনের সঙ্গে বসে চা পান করেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে ইউএনও’র বাসভবন লক্ষ্য করে কয়েকটি ককটেল ছোড়া হয়। সবাই সেখানে বিস্ফোরিত ককটেলের আলামত পড়ে থাকতে দেখেন। তবে ইউএনও ওসিকে ফোন করলে ওসি বলেন, পটকা ফুটেছে।পরদিন ২৩ ডিসেম্বর মতলেব ও তার লোকজন ইউএনও’র বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরে সেদিন রাত থেকেই আবারও মাটিকাটা শুরু হয়। নতুন ইউএনও আসেন জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি আসার পরে গত ২০ ফেব্রুয়ারি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি-এসিল্যান্ড) আরিফ হোসেনকে নিয়ে মাটিকাটার জায়গাটি পরিদর্শন করেন। এ দিন তারা সরকারি খাসজমির সঠিক সীমানা নির্ধারণ করে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেন। এখানে মাটি কাটা যাবে না বলে সাইনবোর্ডও স্থাপন করেন। পরে তুলে ফেলা হয় লাল পতাকা ও সাইনবোর্ড। সবশেষ গত ১১ এপ্রিল বিকালে সেখানে অভিযানে যান ইউএনও জান্নাতুল ফেরদৌস, এসিল্যান্ড আরিফ হোসেন ও থানার নতুন ওসি মিজানুর রহমান। উপজেলা প্রশাসনের কর্মচারীরা খননযন্ত্র অকেজো করার চেষ্টা করলে সেখানে আসেন মতলেবের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন দেশীয় অস্ত্রধারী। এ অবস্থায় যথেষ্ট ফোর্স না থাকায় অভিযান না চালিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয় উপজেলা প্রশাসন। ওসি নিজে সেখানে উপস্থিত থাকলেও মাত্র তিনশ মিটার দূরের থানা থেকে একজন পুলিশ সদস্যও সেখানে আসেননি। এতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওসি মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সেদিন একটা মিটিং শেষে ইউএনও বললেন, বড়াল নদের উৎসমুখে যাবেন। আমি সঙ্গে ছিলাম। সেখানে কিছু ঘটেনি।’ মাটি খেকোদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।তবে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুরাদ পাশা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের সময়ে বালুমহালে যাইনি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরেও আমি হাটঘাটের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। আমাদের রাজনৈতিক সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে।’ ইজারা ছাড়াই মাটিকাটার বিষয়ে সাবেক ছাত্রদল নেতা মতলেব বলেন, ‘আমরা তো বালু কাটছি না। ভরাট মাটি কাটছি। ইজারা দিলে বালু কাটব।’ নিরাপত্তার সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে এসিল্যান্ড আরিফ হোসেন বলেন, ‘আমরা কয়েক দফা চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সেখানে নিরাপত্তার সংকট রয়েছে। এটা বন্ধ করতে হলে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পরিবেশ অধিদপ্তর ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে সমন্বিত অভিযান দরকার।’চারঘাটের ইউএনও জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘অবৈধ মাটি খননের কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনা হুমকির মুখে। আমরা বিষয়টি দেখছি। বেশ কয়েকবার অভিযানও চালিয়েছি। কিন্তু বন্ধ হয়নি। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট দিয়েছি।’
