রানওয়ের লাইট ভাঙার ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়নি


শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের ভাঙা লাইটের সঙ্গে ঘর্ষণ লেগে বিমানের চাকা ফেটে যাওয়ার ঘটনাটি নিয়ে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি বেবিচক। তবে বিমান দুর্ঘটনার এই বিষয়টি দিনভর সিভিল এভিয়েশনজুড়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বিমানের দাবি সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) গাফিলতির কারণে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। ফলে তাদের উড়োজাহাজের সামনের একটি চাকার টায়ার পুরোপুরি ফেটে গেছে। বাকি একটি চাকা ভালো ছিল। পাইলটরা এক চাকার ওপর ভর করে বিমানের দুর্ঘটনাকবলিত উড়োজাহাজটিকে শাহজালালে জরুরি অবতরণ করিয়েছিলেন। দুর্ঘটনায় যদি সামনের নোজ হুইলের দুটি চাকা ক্ষতিগ্রস্ত হতো তাহলে ফ্লাইটটির অবতরণে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতো। এতে উড়োজাহাজের পাশাপাশি যাত্রীদেরও হতাহতের শঙ্কা থাকত। বিমানের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের প্রকৌশল শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, বোয়িং ৭৩৭-এর এই উড়োজাহাজের সামনের চাকাটি লাগানো হয়েছিল মাত্র ২ মাসও হয়নি। চাকাটির পুরোপুরি টেম্পার ছিল। উড্ডয়নের আগেও ৩ দফায় চাকাগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল। তখনো চাকাগুলোর কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। মূলত রানওয়ের লাইটটি ভেঙে রানওয়ে থেকে বেরিয়ে আসার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে। টেকঅফের আগে উড়োজাহাজটির গতিবেগ ২৫০ কিলোমিটারের বেশি ছিল। এ কারণে রানওয়ের ভাঙা লাইটের সঙ্গে উড়োজাহাজের ঘর্ষণে চাকাটি দ্রুত ফেটে যায়। এদিকে ফ্লাইট উড্ডয়ন ও অবতরণের পর রানওয়ে পরিষ্কার করার জন্য দুটি রানওয়ে সুইপার মেশিন ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হলেও সেগুলো এখনো ক্রয় করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে বেবিচকের কাছে ৩টি মেশিন থাকলেও সেগুলো ২টি মেশিন বেশিরভাগ সময় নষ্ট থাকছে। এ নিয়ে দুই দফায় দরপত্র আহ্বান করেও মেশিন দুটি ক্রয় করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে শাহজালালের রানওয়েতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বস্তু (এফওডি) পড়ে থাকার অভিযোগ আছে। শাহজালালের সাবেক নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জরুরি ভিত্তিতে দুটি অত্যাধুনিক সুইপার গাড়ি ক্রয়ের জন্য বেবিচককে চিঠি দিয়েছিল দীর্ঘদিন আগে। কিন্তু সেগুলো এখনো কেনা সম্ভব হয়নি। এয়ারলাইন্স মালিকদের অভিযোগ একটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০-ইআর এয়ারক্রাফটের দাম ১২শ থেকে ১৫শ কোটি টাকা। শাহজালালের ঝুঁকিপূর্ণ রানওয়ের কারণে যদি কোনো এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনায় পড়ে সেজন্য এই ক্ষতিপূরণ কে বহন করবে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিয়ম হলো বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের পর দ্রুতগামী সুইপিং গাড়ির মাধ্যমে রানওয়ে পরিষ্কার করা। এছাড়া সপ্তাহে অন্তত ২ বার ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ রেখে রানওয়ে ক্লিন করতে হয়। কারণ বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের পর রানওয়েতে নুড়িপাথর তৈরি হয়। এছাড়া অনেক সময় বিমানের অনেক পার্টস, ধ্বংসাবশেষ (এফওডি) এবং ক্ষতিকর বস্তু রানওয়েতে পড়তে পারে। যেগুলো উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় চরম ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন আইকাও’র রুলস অনুযায়ী বিমানবন্দরের রানওয়ে নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। বিমানবন্দরের ক্যাটাগরি আপডেট করারও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কারণ প্রতিটি উড্ডয়ন অবতরণের পর রানওয়েতে ধ্বংসাবশেষ, রাবার ঘর্ষণ, বালি, নুড়িপাথর বা আলগা জিনিস পড়ে থাকে। এছাড়া অ্যাপ্রোন ও ট্যাক্সিওয়েতে পাথর, তেল, ক্যান, বোতল, পেরেক, প্লাস্টিক ব্যাগ, স্যুটকেসের চাকা, হাতল, তালা ও লাগেজট্যাগ পড়ে থাকে। সাধারণত এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিনগুলো চলমান অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা এসব আলগা উপাদান সহজেই শোষণ করতে পারে। এতে ইঞ্জিনের প্রপেলার বা কম্প্রেসার ব্লেডের মারাত্মক ক্ষতি হয়। উড়ন্ত অবস্থায় মাঝ আকাশে প্রপেলার বা জেট ইঞ্জিন বিস্ফোরণের ঝুঁকিও থাকে এসব বস্তুর কারণে। বিমানের একজন পাইলট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রানওয়ে পরিষ্কারের কাজটি খুবই টেকনিক্যাল ও দুরূহ। একটি এয়ারক্রাফট যখন রানওয়েতে অবতরণ করে তখন তার প্রতিটি টায়ার রানওয়েতে ১.৫ পাউন্ড পর্যন্ত কালো রাবার ছেড়ে দেয়। একটি এয়ারবাসের (এ-৩৮০) ২২টি চাকা থাকে। অবতরণের সময় ঘর্ষণে এসব চাকার রাবার রানওয়ের পৃষ্ঠকে কালো ও মসৃণ করে তোলে। রানওয়েতে থাকা বিভিন্ন লাইনের সাদা বা বিভিন্ন কালারের দাগগুলোকে ঢেকে দেয়, যা একটি ফ্লাইটের নিরাপদ অবতরণের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি দ্রুতগামী প্লেনের টায়ার রানওয়ের কংক্রিটে আঘাত করলে এর ঘর্ষণ প্লেনকে ধীর করে দেয়। কিন্তু রানওয়ে যত মসৃণ হবে ঘর্ষণ তত কম হবে। ঘর্ষণ ছাড়া একটি প্লেন থামানো ও নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এতে অনেক সময় এয়ারক্রাফট রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে। এছাড়া দুর্ঘটনাক্রমে রানওয়ে বা প্ল্যান স্ট্যান্ডে তেল বা জ্বালানি ছিটকে পড়লে তা রানওয়েতে গুঁড়া ও দানাদার উপাদান তৈরি করে। ভেজা অবস্থায় রানওয়ের লাইন দেখা যায় না। এসব রাবার ম্যানুয়ালি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা অসম্ভব। গরম পানি স্প্রে করে সুইপিং মেশিন দিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করতে হয়।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বিদেশি এয়ারলাইন্সের স্থানীয় জিএসএস মালিক বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা-যাওয়া করা একেকটি উড়োজাহাজ অনেক মূল্যবান। এগুলো সুরক্ষার দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের। অথচ কয়েক কোটি টাকার একটি রানওয়েতে সুইপার না থাকায় ১২-১৩শ কোটি টাকার একেকটি উড়োজাহাজ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।