লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক


মুমিন বান্দা যখন তালবিয়া পড়ে, তখন তার ডানে আল্লাহর যত সৃষ্টি থাকে, গাছ হোক আর পাথর হোক, সবাই তার সঙ্গে লাব্বাইক বলে। এমনকি এদিক-ওদিকের সব জমিনই বিস্তৃত হয়ে যায় (তিরমিজি শরিফ)। হালাল উপায়ে অর্জিত অর্থে হজ করতে হবে। হজে যাওয়ার উদ্দেশ্য যেন শুধুই আল্লাহকে পাওয়ার জন্য হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য বা নাম কামানোর জন্য না হয়। ‘যারা বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যাওয়ার সামর্থ্য রাখে তাদের ওপর হজ করা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ করা হয়েছে’ (সূরা আল ইমরান ৯৭)। হজ একটি কায়িক শ্রমের ইবাদত। তাই বিত্তবান, শক্তি-সামর্থ্যবান ব্যক্তি অন্য কাউকে দিয়ে বদলি হজ করালে তা শুদ্ধ হবে না। আরাফাতের মাঠে উপস্থিত, মুজদালিফায় রাতযাপন, মিনাতে কঙ্কর নিক্ষেপ ও কুরবানি এবং মক্কায় ফিরে কাবা শরিফ তাওয়াফ এসব অনুষ্ঠান সমাহারে হজ। হজ ও ওমরাহ নিয়মে মদিনা গমনের কোনো বিধি সরাসরি কিতাবে আসেনি বলে অনেকেই গুরুত্ব দিতে নারাজ। তবে মদিনা শরিফে রাসূল (সা.)-এর রওজা মোবারক জেয়ারতের ফলে এক নবপ্রেরণা এবং নবোদ্দীপনা রাসূলপ্রেমিক হাজিরা লাভ করেন। রাসূল (সা.)-এর উক্তি : যে ব্যক্তি হজ সম্পন্ন করল এবং আমার মৃত্যুর পর আমার কবর জিয়ারত করল, সে যেন জীবদ্দশায়ই আমার জিয়ারত করল (মিশকাত)। যারা কাছ থেকে আমরা হজের পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হয়েছি, তাকে বাদ দিলে হজ ও ওমরাহ কবুল হবে? প্রিয়জনের কবর জিয়ারতে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। অথচ যার শাফায়াতে হাশরে মিলবে মুক্তি, তার জিয়ারতে অনীহা প্রকাশের কারণ আমার জানা নেই। তার মহান দরবারে পৌঁছাতে পেরে আশেকে রাসূলরা দরুদ ও সালামের নজরানা পেশ করেন আবেগভরে। তপ্ত অশ্রুতে বুক ভাসিয়ে তার পদযুগলে রুহকে উৎসর্গ করতে। অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে। এভাবে এক স্বর্গীয় আনন্দভরা পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী হন হাজিরা। আল্লাহপ্রেমিক হজযাত্রীরা যাত্রার বহু আগে থেকে হাজার নিয়ম-কানুন রপ্ত করতে থাকেন। নিয়মাবলি না জানার কারণে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিভিন্ন রকমের হজ নির্দেশিকা পুস্তক বিনামূল্যে সব যাত্রী পেয়ে থাকেন। এমনকি যাত্রার আগ মুহূর্তে আশকোনা হজক্যাম্পে কিতাবুল হজ নামের বইটি বিনামূল্যে বিতরণের ব্যবস্থা থাকে। দেশে প্রখ্যাত আলেম-ওলামাদের সঙ্গে বহুবার হজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শেখ গোলাম মহিউদ্দীন বইটির প্রণেতা। আফসোস অনেকেই এ বইগুলো ঠিকমতো পড়ে না, পড়ার বদলে দুনিয়াবি কাজকর্ম এবং মনগড়া কিছু আচার অনুষ্ঠানের জন্য সময় ব্যয় করতে পছন্দ করেন। ফলস্বরূপ হজে গিয়ে অজ্ঞতার কারণে ফরজ বাদ দিয়ে ফেলেন। ফরজ বাদ পড়লে হজ বাতিল হয়ে যায়। ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভটি হাতছাড়া হয়ে গেল। পুরুষদের ইহরামের পোশাক সেলাইবিহীন কাফনের কাপড়ের মতো। আর নারীদের মুখমণ্ডল ব্যতীত সর্বাঙ্গে অনুজ্জ্বল রঙের পোশাক দ্বারা আবৃত্ত রাখতে হবে। এটি হজের প্রথম ফরজ। এখানে আফসোসের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত পুরুষদের সতর। এটি প্রদর্শন করা কবিরা গুনাহ। অনেকেই টাখনু উন্মুক্ত রাখতে গিয়ে হাঁটুর ওপরে ইহরাম উঠিয়ে ফেলেন। নারীদের অবস্থা তো আরও করুণ। অনেকে পুরুষদের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সাদা পোশাক পরিধান করেন, যা নাকি পুরুষদের ইহরামের মতো মোটা কাপড় নয়, মিহি সুতায় বোনা সাদা কাপড়, এতে আবরু রক্ষা হয় না। ফলে কবিরা গুনাহ হয়ে যায়। অনেকে কিছু অঙ্গ অনাবৃত্ত রেখে অতি উজ্জ্বল রঙে নিজেকে সজ্জিত করেন। প্রথম কথা হচ্ছে, সঠিকভাবে ইহরাম না পরার কারণে হজ বাতিল। আর কবিরা গুনাহের তো ক্ষমা চাওয়া ছাড়া মাফ হয় না। কবিরা নিয়ে কবরে গেলে অন্যের দোয়াতে তা মাফ পাওয়া যায় না। কবিরা গুনাহের ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে মুফতি তোফায়েল গাজালি একটি লিস্ট ছাপিয়ে ছিলেন, তা সংগ্রহে রাখলে সবাই উপকৃত হব। হজ গমনের আগে তওবা এবং ইস্তিগফার দিয়ে পবিত্র হতে হবে। ঋণ থাকলে তা পরিশোধ এবং কারও সঙ্গে মনোমালিন্য থাকলে তা মিটিয়ে নিতে হবে। মহিলা হাজিদের অবশ্যই জামাতের সঙ্গে নামাজ এবং জুমার নামাজের নিয়ম ভালোভাবে জেনে নিতে হবে। কাবা আল্লাহতায়ালার গৃহ হওয়ার কারণে তাঁর প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। কারণ, খোদায়ি দিদারের আগ্রহ বাড়ে কাবা দর্শনের মাধ্যমে। তাই এ পবিত্র গৃহ দর্শনের প্রতিশ্রুতি সওয়াব লাভের আশা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে প্রেমময়ের প্রেম লাভের আকাঙ্ক্ষা করা দরকার। হৃদয়ের সব আকুতি দিয়ে তাওয়াফ করতে হবে। তাওয়াফ নামাজ তুল্য, তাই অতি প্রয়োজন ছাড়া বাক্যব্যয় থেকে বিরত থাকতে হবে। আফসোসের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, অনেকেই তাওয়াফ এবং রাসূল (সা.)-এর রওজা জিয়ারতের সময় ছবি, ভিডিও, এমনকি লাইভেও যায়। এটি খুবই গর্হিত কর্ম। আমরা কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে গিয়ে কি এ কাজগুলো করার সাহস পাই? বেয়াদবি করার ফলে প্রার্থনার একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। মিনা, মুজদালিফা ও আরাফায় অত্যন্ত আদব রক্ষা করে ইবাদতের মধ্যে সময় ব্যয় করতে হয়। হাজিরা আল্লাহর মেহমান, তাই তিনি যেভাবে রাখবেন সন্তুষ্টচিত্তে তা গ্রহণ করাই সমীচীন। হজের এ কয়টি দিন বেশ কষ্টের, এখানে ধৈর্য ধারণের জন্য আল্লাহ পাকের সাহায্য চাইতে হবে, শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা পেতে। কঙ্কর নিক্ষেপ একটি প্রতীক মাত্র। তাই এটি নিক্ষেপ করার সময় কল্পনায় নিজের অন্তরে ওতপেতে থাকা নফসের উদ্দেশ্যে মারতে হবে। আরাফার মাঠে অবস্থান হজের অন্যতম একটি ফরজ। মহোৎসবে যোগদান করতে আরাফার মাঠে একত্রিত হন সফেদ পোশাকে, বিশ্বের মুসলিম নারী-পুরুষ অশ্রু বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ধুয়ে ফেলেন জীবনের সব কালিমা। সেদিন সর্বত্র উচ্চারিত হতে থাকবে, একমাত্র লাব্বাইক ধ্বনি। সেদিন ভিন্ন আকারে সিদ্ধপুরুষও এ বিশ্ব সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে থাকনে। তাই কোনো কিছুকে আঘাত বা স্থানান্তর করা থেকে বিরত থাকতে হয়। নিজেকে রাখতে হয় মুর্দার মতো। হজের মতো আত্মোৎসর্গের আর দ্বিতীয় অনুষ্ঠান নেই। এতে আত্মার পরিশুদ্ধি হয়। নফস বশীভূত হয়। নির্মল শান্তি লাভ হয়। সম্মান লাভ হজের উদ্দেশ্য নয়। হজ তন্ময়তা লাভের প্রধান উপকরণ। যে হজ উদ্যাপনে স্ত্রী ও সন্তানাদির চিন্তায় ব্যস্ত, উপার্জনের আকাঙ্ক্ষা, প্রশংসা লাভের ইচ্ছা ও স্বার্থসিদ্ধির লেশ থাকে, সে হজ লৌকিক আচারে পরিণত হয়। মহান রাব্বুল আলামিন বিশুদ্ধ হজ পালন করার তৌফিক দান করুন।