শত বাধা পেরিয়ে এগোচ্ছে নারী


নারী নিজ যোগ্যতায় এগোচ্ছে। আকাশপথ থেকে স্থলপথেও। শিক্ষা, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতিসহ বিভিন্ন বাহিনীতেও তাদের উপস্থিতি দারুণ। তবে বাল্যবিবাহ, অনিচ্ছাকৃত সন্তানধারণ, যৌন নির্যাতন, পাচার নারীর অগ্রগতির পথরোধ করে। অন্যদিকে শ্রমমূল্যের বৈষম্য তাদের দারুণভাবে নাড়া দেয়।পরিসংখ্যান দরকার নেই, শহর, পাড়া-মহল্লার গৃহকোণে চাপা কান্নার আওয়াজ বলে দেবে-নারীকে অপমান করা হয়, নির্যাতন করা হয়, হত্যা করা হয়, অ্যাসিড নিক্ষেপ করা হয়, ধর্ষণ-সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন, বাল্যবিবাহ হয়। আবার পাড়ার কিশোর-কিশোরী, স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সেই মেয়েটাই থানায় গিয়ে নিজের বিয়ে আটকেও দেয়। প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ্ব নারী দিবস উদ্যাপন হবে। ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য-‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’।সূত্র বলছে, নারী এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে বৈষম্যও এগোচ্ছে। পুরুষ কৃষক ন্যায্যতা পেলেও নারী কৃষক কোনো স্বীকৃতি-সম্মানই পাচ্ছেন না। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, কৃষি খাতে নারীর সম্পৃক্ততা ক্রমেই বাড়ছে। ৫০ বছরে কৃষিতে নারীর সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে। এখানে নারীর সংখ্যা বাড়লেও ভূমির মালিকানা নেই বললেই চলে। মজুরির ক্ষেত্রে পদে পদেই চরম বৈষম্য।মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহিন আনামের ভাষ্য, নারী নিজ নিজ যোগ্যতায় এগোচ্ছে। কিন্তু নির্যাতন-সহিংতাও বাড়ছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন ঘরে-বাইরে, এমনকি অন্দরমহলেও। কৃষিতে নারীর স্বীকৃতি দিতে বহু বছর ধরে আন্দোলন করে আসছি, সরকারের কাছে জানাচ্ছি; কিন্তু তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নারী এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সবার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত জরুরি। প্রতিবন্ধী নারী সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন। কারণ, অপরাধীরা মনে করে, এদের নির্যাতন করে সহজেই পার পাওয়া যাবে। পুলিশ কিংবা আদালতে নির্যাতনের শিকার নারীরা নির্যাতনের বিষয়টি যথাযথ উপস্থাপনাই করতে পারবে না-এমন ধারণা রয়েছে নির্যাতনকারীদের মননে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী জানান, প্রতিবন্ধী কিংবা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারী সবচেয়ে বেশি যৌন সহিংসতার শিকার হন। ঘৃণার পাত্র হন সমাজে। আবার নির্যাতনের শিকার হলেও খোদ পরিবার ও স্বজনদেরই বিশ্বাস করানো যায় না। অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার পিংকি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন। শরীরে ক্ষত স্পষ্ট। ক্ষত নিয়ে ১৬ বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বিচার পাচ্ছেন না। অ্যাসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, শত নারীর এগিয়ে যাওয়াকে ম্লান করে দেয় একটি নারীকে অ্যাসিড দিয়ে ঝলসে দেওয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অ্যাসিড সন্ত্রাসের মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় আসামি খালাস পেয়ে যায়। খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, মাত্র ৯ শতাংশের কম মামলায় অভিযুক্তদের সাজা হয়।শুধু কন্যাসন্তান জন্মের কারণে বহু মা পরিবার-স্বজনদের কাছে ঘৃণার পাত্র হন। কেউ আবার খুশিও হন। অনেক ক্ষেত্রে ভ্রূণাবস্থায়ই মরতে হয় ‘কন্যা’কে। পরপর কন্যা জন্ম দেওয়ার কারণে অনেকের সংসার ভাঙছে। নিজ ঘরেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেকে আবার প্রাণভয়ে ভ্রূণ নষ্ট করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশেষ করে নিুবিত্ত আয়ের পরিবারগুলোয় এমনটা বেশি হয়। কখনো মধ্যবিত্ত পরিবাররেও। বিভিন্ন ক্লিনিকে আলট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির মাধ্যমে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয়। কন্যার উপস্থিতি পেলেই ব্যাকুল হয়ে উঠে গর্ভপাত করাতে।এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের গাইনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. শিখা গাঙ্গুলি বলেন, কন্যা নিশ্চয় আশীর্বাদ। কন্যা বলেই ভ্রূণহত্যা ভয়াবহ অপরাধ। আমি বিশ্বাস করি, সমাজের মানুষ এখন সচেতন হচ্ছে। অনেকটা কমে এসেছে। তবে পরপর যাদের ২/৩টি কন্যাসন্তান হচ্ছে, পরবর্তী সময়ে আবারও কন্যাসন্তান-লিঙ্গ নির্ধারণ হলে অনেকেই মন খারাপ করেন। পরিবারে তারা ঘৃণার পাত্র হচ্ছেন কি না, আমার জানা নেই। তবে ভারতে ভ্রূণ-লিঙ্গ নির্ধারণ, ভ্রূণ হত্যা প্রতিরোধে আইন রয়েছে। বাংলাদেশে আছে কি না, জানা নেই। নারী এখন এগিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও। সবার আগে সামাজে নারী-পুরুষের মধ্যে যে বৈষম্য, তা দূর করতে হবে। সচেতনতাই পারে এমনটা রোধ করতে।দলিত নারীদের মধ্যেও অনেকে স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। কেউ আবার পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছেন, চাকরি খোঁজছেন। এখানে বৈষম্য জাত নিয়ে। রাজধানীর টিটিপাড়া দলিত কলোনিতে থাকা এক পরিবারের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দম্পতি জানান, তাদের মেয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করেছে। চাকরির জন্য গেলে যখন ধর্ম-জাত দেখে, তখনই চাকরি হয় না। নিজেরা সিটি করপোরেশনে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন। অবশেষে বিয়ে দিয়েছেন, স্বামী জুতার ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন।নারীর প্রতি অ্যাসিড সন্ত্রাস, খুবই ভয়াবহ। অ্যাসিড সন্ত্রাসে মাত্র ৯ ভাগ মামলায় সাজা হচ্ছে। ৯১ ভাগ মুক্ত হয়ে পড়ছে। অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, ২০ বছরে দেড় হাজারের বেশি নারী ও শিশু অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। সাজা হয়েছে মাত্র ৩৪৩ জনের। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, অ্যাসিডের মামলায় ১৬ বছরে ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কারও সাজা কার্যকর করা হয়নি। অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২ অনুযায়ী ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ করার কথা বলা আছে।পরিস্থিতি নাজুক হলেও নারীর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা হয় না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। তিনি জানান, নারী নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যাবে, এটা স্বাভাবিক। পুরুষের করুণায় নয়, এগোচ্ছে নিজ যোগ্যতায়। কিন্তু পদে পদেই বৈষম্য। পুরুষশাষিত সমাজ যেন আঁকড়ে ধরতে চায় নারীর এগিয়ে যাওয়াকে। নির্যাতন, ধর্ষণ কমছে না, বরং বাড়ছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না। সহিংসতার মাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।মালেকা বানু বলেন, পরিবার, গণপরিবহণ, গণপরিসরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বাদ যাচ্ছেন না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। বর্তমানে ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অর্থাৎ ভার্চুয়াল জগতেও নারী নিরাপদ নন। নারীর অগ্রযাত্রাকে টেকসই করতে হলে তার প্রতি যে কোনো সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। অনেক আইন হয়েছে, অনেক আইন হওয়ার কথা থাকলেও কোনোটাই যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শুধু নারী নয়, মানুষ নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যাবে-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পদে পদে নারী নির্যাতন, সহিংসতা, বৈষম্য রোধে কি কার্যকর কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন হচ্ছে-প্রশ্ন রাখেন তিনি।শ্রমবাজারে বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ : স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে বাংলাদেশে অর্থনীতির পট পরিবর্তনে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ। এই পাঁচ দশকে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের সফলতায় বড় অবদান রেখেছেন নারী। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ, যা পাকিস্তানে ২৩ শতাংশ। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে দেশে কর্মক্ষেত্রে নারী ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। বিবিএসের সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপে নারী হিস্যা ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ১ কোটি ৮৭ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা-অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছেন।