কিডনি রোগের ঝুঁকি কমাতে সচেতনতা জরুরি


দেশের প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। প্রতিবছর বিকল হচ্ছে অন্তত ৪০ হাজার মানুষের কিডনি। রোগটির ঝুঁকি কমাতে মানুষকে সচেতন করা জরুরি। একই সঙ্গে কিডনি রোগের চিকিৎসায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। গতকাল সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন। ‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য’ শীর্ষক ওই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে সমকাল ও বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসি। সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. নিজামউদ্দিন চৌধুরী, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম, কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. মামুন মোস্তাফি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আসিয়া খানম, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজির নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. কাজী শাহনূর আলম, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রতন দাসগুপ্ত, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হসপিটালের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ, আজগর আলী হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. নবীউল হাসান রানা, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজওয়ানুর রহমান এবং বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসির এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম মাহমুদুল হক পল্লব। বৈঠক সঞ্চালনা করেন সমকালের বার্তা সম্পাদক (অনলাইন) গৌতম মণ্ডল। বৈঠকে আবু সাঈদ খান বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীকে সুস্থ রাখা জরুরি। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের রোগ আমাদের সুস্থতা কমিয়ে দিচ্ছে। রোগমুক্ত থাকতে যেভাবে শরীরের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন, আমরা তা নিতে পারছি না। কিডনির সমস্যার পাশাপাশি অন্যান্য রোগ আমরা কীভাবে প্রতিরােধ করব, তা নিয়েও ভাবার সময় এসেছে।’ অধ্যাপক ডা. মো. নিজামউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘জনগণকে সচেতন করার মাধ্যমে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করতে হবে। এটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। ভেজাল খাদ্য এবং বায়ু ও পানিদূষণের কারণে দেশে কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ডায়াবেটিস রোগী বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বজুড়েই কিডনি রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।’ প্রতিবছর দেশে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ৯০ শতাংশ কিডনি রোগী ডায়ালাইসিস সেবা নিতে পারেন না।’ তিনি জানান, দেশে কিডনি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন ৩৬৮ জন, এর মধ্যে ২৫ জন কিডনি প্রতিস্থাপন চিকিৎসক। বিশ্বে কিডনি বিকল হওয়া রোগীর হার ১১ থেকে ১৬ শতাংশ হলেও দেশে তা ২২ শতাংশ বলে উল্লেখ করেন তিনি। কিডনি প্রতিস্থাপন ও ডায়ালাইসিসকে ব্যয়বহুল চিকিৎসা উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম বলেন, ‘কিডনি ইনস্টিটিউট বিনামূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করে। গত বছর ২২ জন রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।’ তবে ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া দেশের বাইরে কিডনি প্রতিস্থাপনের সুযোগ না দেওয়ার জন্য সরকারকে আইন করার অনুরোধ করেন তিনি। ডা. মো. বাবরুল বলেন, ‘সরকার এক হাজার ৫০০ শয্যার ডায়ালাইসিস শয্যা স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। ডায়ালাইসিস সেবার জন্য ২ হাজার ৪০০ টাকা করে ভর্তুকি দিচ্ছে। তবে কিডনি রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’ অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘২০২২ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করতে খরচ হয় ২ হাজার ৮০০ টাকা। আর ডায়াজার রিইউজ করলে খরচ হয় ১ হাজার ৭০০ টাকা। বেসরকারি হাসপাতালে এই খরচ ৫ হাজার টাকা বা তার বেশি। তবে সরকারি হাসপাতালে ২০ হাজার টাকায় ছয় মাসে ৪৮টি ডায়ালাইসিস হয়। প্রতিটি ডায়ালাইসিসের জন্য ৪০০ টাকা নেওয়া হয়, যা সরকারের রাজস্ব খাতে চলে যায়। আর বাকি টাকা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়।’ অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ বলেন, ‘দেশে ৫ লাখ রোগীর জন্য একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। ফলে চাইলেও এই বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বড় সংকট হলো, রোগীর শরীরে কী ধরনের সমস্যা রয়েছে তা অনেকে জানেন না, পরীক্ষাও করেন না। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।’ অধ্যপক ডা. মামুন মোস্তাফি বলেন, ‘কিডনি রোগ নিয়ন্ত্রণে খাবার অনেক বড় ভূমিকা রাখে। একদিকে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ খেতে হয়, অন্যদিকে রোগটি যাতে বাড়তে না পারে এমন খাবার খেতে হয়। যতটুকু প্রস্রাব হবে, তার চেয়ে অন্তত দুই গ্লাস বেশি পানি কিডনি রোগীকে পান করতে হয়। এই রোগে আক্রান্তরা স্বাভাবিকভাবে ৭ শতাংশ চর্বিযুক্ত খাবার খেতে পারেন। তবে তাদের দৈনিক ৪০ গ্রাম প্রোটিন খাওয়া প্রয়োজন।’ ডায়াবেটিস ছাড়াও নানা কারণে কিডনি বিকল হতে পারে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কিডনির ছাকনির প্রদাহ, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ, জন্মগত বা জিনগত কারণেও কিডনি বিকল হয়। তবে ৫০ শতাংশ রোগীর তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না।’ অধ্যাপক ডা. আসিয়া খানম বলেন, ‘৮০ শতাংশ কিডনি রোগীর রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। হরমোনজনিত কারণে তাদের রক্ত তৈরি হয় না। পাশাপাশি কিডনি রোগের কারণে শরীরে কিছু নতুন হরমোন তৈরি হয়।’ ক্লান্ত লাগা ও খেতে না পারা কিডনি রোগের উপসর্গের মধ্যে পড়ে এবং ছোট কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ শনাক্ত করা সম্ভব বলে উল্লেখ করেন তিনি। ডা. এম এ সামাদ বলেন, ‘কিডনি রোগ অনেক বেশি ক্ষতি করে। তাই এটি প্রতিরোধেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কিডনি রোগীরা অন্যান্য রোগেও আক্রান্ত হন বেশি। যাদের কিডনি বিকল হয়ে গেছে, তারা অধিকাংশ সময় চিকিৎসা নিতে পারেন না। কারণ এই চিকিৎসায় ব্যয় বেশি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সচেতন করলে এই রোগ ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ প্রতিরোধ সম্ভব।’ কিডনি রোগ প্রতিরোধে শারীরিক ব্যয়াম গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ডা. রতন দাসগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে হাঁটার সুযোগ নেই। এই সুযোগ কীভাবে তৈরি করা যায়– সে ব্যাপারে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি জাতীয়ভাবে ডায়েটের ব্যালেন্স সম্পর্কে আমরা জানি না। মেডিকেল শিক্ষার্থীদেরও খাদ্যে প্রোটিনের পরিমাণ ৩০ গ্রামের কম। কিন্তু চাহিদা হলো– প্রতি কেজিতে ১ গ্রাম। সে ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৫০ শতাংশেরও কম। এই প্রোটিন দিয়ে মানুষের সুস্থ থাকা অসম্ভব।’ অধ্যাপক ডা. নবীউল হাসান রানা বলেন, ‘কিডনি রোগ প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে প্রতিরোধ করা সহজ হয়। এটি যে কঠিন তা কিন্তু নয়; শুধু ব্লাড প্রেশার, হাইপারটেনশন, ব্লাড সুগার ও ইউরিন পরীক্ষা এবং আলটাসনোগ্রামে মাধ্যমে এটি নির্ণয় করা যায়।’ তিনি বলেন, ‘দেশে পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস শুরু হয়েছে। তবে এখনও জনপ্রিয় হয়নি। এই সেবা সব জায়গায় ছড়িয়ে দিলে ঘরে বসে ডায়ালাইসিস সেবা নেওয়া যাবে।’ বৈঠকে অধ্যাপক ডা. কাজী শাহনূর আলম বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ জন্য কখন ওষুধ শুরু করতে হবে, সে ব্যাপারে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। রক্তচাপ আছে ধারণ করে যখন তখন ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। এই ওষুধ খাওয়া একবার শুরু করলে সারাজীবন খেতে হয়। প্রদাহজনিত কিডনি রোগ যখন শনাক্ত হয় তখন দেখা যায়, তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগীরও ৫০ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ থাকে।’ শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুস্থ রাখা আমাদের দায়িত্ব উল্লেখ করে ডা. রেজ‌ওয়ানুর রহমান বলেন, ‘কিডনি ডায়ালাইসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপন সেবার প্রসার ঘটাতে পারলে অনেক রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কিডনি প্রতিস্থাপন জোর গতিতে এগিয়ে চলছে। এ ক্ষেত্রে মরণোত্তর অঙ্গদানের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পারলে আরও বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব হবে।’ এস এম মাহমুদুল হক পল্লব বলেন, ‘দেশি কোম্পানি হিসেবে আমরা সর্বপ্রথম কিডনি রোগীর রক্তশূন্যতার চিকিৎসায় রেনেসিস নামে খাওয়ার ওষুধ বাজারজাত করেছি। যার ফলে এ-সংক্রান্ত ওষুধের ব্যয় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। এ ছাড়া যাদের কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে, তাদের সব ধরনের ওষুধ স্বল্পমূল্যে বাজারজাত করছে বীকন।’