৯ বছরে ঝরেছে ২০ প্রাণ ময়লার গাড়ি এখন নয়া ঘাতক


ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িগুলো এখন যেন নয়াঘাতকে পরিণত হয়েছে। গত ৯ বছরে ময়লার গাড়ির চাপায় শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২০ জনের প্রাণ গেছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে মুগদা এলাকায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় প্রাণ হারিয়েছে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাহিন আহমেদ (১৩)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ঘটনা অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। এর সুষ্ঠু বিচার না হলে এমন দুর্ঘটনা বাড়তেই থাকবে। জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চালকদের অনেকেরই নেই ভারী যান চালানোর লাইসেন্স। মশককর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ সিটি করপোরেশনের বিভিন্নজনকে দিয়ে চালানো হচ্ছে এসব ভারী যানবাহন। ময়লার গাড়িতে ড্যাশ ক্যাম লাগানো হলেও পরে তা খুলে ফেলছেন চালকরা। আর এ সুযোগে যাকে তাকে দিয়েই বদলি চালানো হচ্ছে ময়লার গাড়িগুলো। সর্বশেষ দক্ষিণ সিটির ময়লার গাড়ির চাপায় মাহিনের মৃত্যুতে বাকশক্তি হারিয়েছেন বাবা মাসুম মিয়া। আর বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই মা ফাতেমার। বড় ভাই মাহফুজ আহমেদও থামাতে পারছেন না কান্না। শনিবার দুপুরে মাহিনের বড় ভাই মাহফুজ আহমেদ বলেন, প্রাণোচ্ছ্বল ভাইটা (মাহিন) আমার কী সুন্দর বাসা থেকে বের হয়ে গেল, আর ফিরল লাশ হয়ে। কি ডাকাত ময়লার গাড়ি! এ ঘটনার পর আমার বাবা শোকে নির্বাক হয়ে গেছেন। আর মাকে দুজনে চেষ্টা করেও বিছানা থেকে তুলে দাঁড় করাতে পারছি না। জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে বাসা থেকে বের হয় মাহিন। মুগদার মদিনাবাগে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ময়লার গাড়ির ধাক্কায় সে গুরুতর আহত হয়। প্রথমে মুগদা হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক রাত ১১টায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মাহফুজ বলেন, ময়লার গাড়িটি চালাচ্ছিল বদলি একজন। নেশাগ্রস্ত চালক খুব বেপরোয়াভাবে গাড়িটি চালাচ্ছিল। মাহফুজ বলেন, মুগ্দা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পর মাহিনকে কোনো চিকিৎসা না দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানে যদি প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু দেওয়া হতো, তবুও মাহিনকে বাঁচানো যেত। ময়লার গাড়ির ধাক্কায় আর কত প্রাণ যাবে? আর কত মানুষ স্বজন হারাবে প্রশ্ন তুলে মাহফুজ এর সুষ্ঠু বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেদন জানান। সিটি করপোরেশন থেকে কেউ যোগাযোগ করেছিল কিনা-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, শুক্রবার দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বাসায় এসেছিলেন। তিনি সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, পরিবারের যে কোনো সহযোগিতা লাগলে করবেন এবং বিষয়টা তিনি দেখবেন। তিনি আমাদের পরে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। সেই সঙ্গে তিনি ময়লার গাড়ির চালকের কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের আশ্বাস দিয়েছেন। এদিকে মুগদা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুল হোসাইন বলেন, গাড়িটি বদলি একজন চালাচ্ছিল। তার নাম রুবেল। আমরা ঘটনার পরপরই গাড়িটি জব্দ করেছি এবং রুবেলকে ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে শুক্রবার আদালতে পাঠিয়েছি। আদালত পরে শুনানি করে তার রিমান্ড মঞ্জুর করবেন বলে জানিয়েছেন। জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় গত ৯ বছরে অন্তত ২০ জনের প্রাণ গেছে। চালকদের অনেকেরই নেই ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স। মাহিনের মৃত্যুর ঘটনায় মূল ড্রাইভার নয় তাকে চাপা দেওয়া গাড়িটি চালাচ্ছিলেন বদলি একজন। সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রাণ হারানো নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান। তার মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দিনের বেলায় ময়লাবাহী গাড়ি চালানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের নির্ধারিত গাড়ি চালক নিজে গাড়ি না চালিয়ে আরেকজনকে ভাড়া দিয়ে গাড়ি চালিয়েছে। তা অত্যন্ত অন্যায়। আমরা এর আগেও এমন ঘটনা তদন্তে পেয়েছিলাম এবং জড়িত সবাইকে কঠোর শাস্তি দিয়েছি। অভিযোগ আছে করপোরেশনের ময়লাবাহী ভারী গাড়ি চালাচ্ছেন নিরাপত্তা প্রহরী, অফিস সহায়ক, মশককর্মী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী। নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে পরিবহণ বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তারা ভারী যানবাহন চালাচ্ছে। অধিকাংশ চালকের ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নেই। এমনটা জানেন উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গাড়িতে ড্যাশ ক্যামেরা বসালেও তা নষ্ট করে দেন চালকরা। ড্যাশ ক্যাম লাগানো থাকলে তাদের আমরা আমাদের কমান্ড সেন্টার থেকে দেখতে পারি, কোন ড্রাইভার কোন গাড়ি চালাচ্ছে। আসলে এসব কারণে ড্যাশ ক্যাম বসালেও তারা দুদিন পর সরিয়ে নিচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা এখন কঠোর হচ্ছি। পরিবহণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাদিউজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ময়লার গাড়িগুলো চালকরা নিজে না চালিয়ে বহিরাগতদের হাতে ছেড়ে দেন। মশককর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ভারী গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে পড়ছেন। হালকা-পাতলা গাড়ির স্টিয়ারিং ধরতে পারলেই তারা চালক হয়ে যাচ্ছে। তাদের কারও কাছেই ভারী ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অভিযোগগুলো আসলে দীর্ঘদিনের। অভিযোগের প্রেক্ষিতে পরিবহণ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত কর্মকর্তা আছেন, তারা আসলে কি পদক্ষেপ নিয়েছেন? সিটি করপোরেশনের পরিবহণ বিভাগকেও দায়বদ্ধ করার পরামর্শ দেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।