পাকিস্তান মডেলই টিকে আছে
অনলাইন নিউজ ডেক্স
মুক্তিযুদ্ধ তো আকস্মিকভাবে হয়নি। হঠাৎ করে কিছু লোক বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে, তা তো নয়। এর পেছনে একটি স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা ছিল। এটি দীর্ঘদিনের লড়াই ছিল। ’৭১-এর যুদ্ধ যদি মানুষের যুদ্ধ বলি, বহুদিন ধরে মানুষ লড়াই করে একটা স্বপ্ন তৈরি করছিল। তেভাগা আন্দোলন থেকে পঞ্চাশ ও ষাট দশকের আন্দোলন দেখি তো দেখব– যে স্বপ্নের রাষ্ট্রের ছক তৈরি হলো, তা পাকিস্তান মডেলের ঘোরতর বিরোধী। ’৭১-এ এসে আমরা ঠিক করলাম– পাকিস্তান মডেলের কোনো রাষ্ট্র আমরা করব না; ভিন্ন মডেলের রাষ্ট্র করব। অনেকে বলে থাকেন, বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানো যাবে না। এটা বলে বোঝান যে, পাকিস্তান একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র। তবে পাকিস্তান মডেল মানে শুধু ইসলাম বা ধর্মকে ব্যবহার করে নিপীড়নমূলক রাষ্ট্র বোঝায় না। পাকিস্তান মডেল বিরোধিতা বলতে বোঝায়, ২২ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রের মডেলের বিরোধিতা। প্রত্যাশা ছিল– জাতিগত, ধর্মীয়, আঞ্চলিক বৈষম্য-নিপীড়ন থেকে মুক্ত হবে আমাদের রাষ্ট্র।
বাঙালি জাতি নিজেরা জাতিগত বৈষম্যের শিকার। সে জন্য জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিশ্রুতি এবং তার জন্য বিভিন্ন ধরনের তাত্ত্বিক রাজনৈতিক চিন্তা সে সময় তৈরি হয়েছে। ষাটের দশকে গণঅভ্যুত্থানের প্রধান বিষয় ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, যেটা ১১ দফার মধ্যে স্পষ্টভাবে ছিল। এখান থেকেই এসেছে– বাংলাদেশ কোনো প্রকারে আধিপত্যবাদী হবে না। পাট ছিল রাজনৈতিক চিন্তার কেন্দ্রে। বর্তমানে পাট আরও বেশি গুরুত্ববহ বলে আমি মনে করি। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে তা মডেল হতে পারে। এটি বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করবে বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু পাট এখনও অবহেলিত। কথা ছিল, আমলাতান্ত্রিকতা এখানে থাকবে না। এসব প্রশ্ন তুললে অনেকে বলেন, এগুলো নেতিবাচক কথা। এগুলো যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকেই নেতিবাচক বলতে হবে!
ষাটের দশকে যত শিক্ষা আন্দোলন হয়েছে, সবকটির মূল কথা ছিল সকলের জন্য সর্বজনীন যে শিক্ষা, সেটার দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করবে। একমুখী একই ধরনের শিক্ষা সকল নাগরিক পাবে। এই আকাঙ্ক্ষাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর হওয়ার কথা। সম্পদের একটা বিকাশ হয়েছে, কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, শিল্প উৎপাদন বেড়েছে, রাস্তাঘাট বেড়েছে– এতে সন্দেহ নেই। পুঁজিবাদের বিকাশের ধরনে যে ধরনের কাঠামো তৈরি হয়, সে ধরনের কাঠামো তৈরি হয়েছে। মানুষের কথা যদি চিন্তা করি, সেসব আকাঙ্ক্ষার কী হলো। এখনকার ২২ পরিবার পাকিস্তানের ২২ পরিবার থেকে অনেক বেশি সম্পদশালী। শিক্ষা ও চিকিৎসা যে মাত্রায় বাণিজ্যিকরণ হয়েছে, সেটা খোদ পুঁজিবাদের কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রেও ঘটেনি। শিক্ষা ও চিকিৎসা যে এত ব্যবসা মুনাফার ব্যাপার হতে পারে, বাংলাদেশে কেউ চিন্তাও করেনি। বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষ তার সন্তানকে লেখাপড়া করাতে চায়।
কিন্তু শিক্ষা তার দরজা বন্ধ করে রেখেছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষের কাছে কম্পাউন্ডারই ভরসা। পাবলিক হেলথ কেয়ার সিস্টেম এবং পাবলিক এডুকেশন বাংলাদেশে দাঁড়ালই না। যারা ক্ষমতাবান রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তাদের সন্তানদের সঙ্গে তো এখানকার পাবলিক এডুকেশন ও পাবলিক হেলথ কেয়ারের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই তাদের কিছু আসে-যায় না। প্রাথমিক স্কুলে যেখানে আরও শক্তিশালী বিনিয়োগ করা দরকার, সেখানে শিক্ষক নেই। সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব নেওয়া হচ্ছে; কিন্তু শিক্ষা ও চিকিৎসায় কেবল নেই নেই নেই। এর মধ্যে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, সেখানে মানুষের কথা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে। নদী কেটে সরু করা হবে! যেসব বিদ্যুৎ প্রকল্প হয়েছে, তা বাংলাদেশকে ঋণী করছে এবং বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশকে ভয়ংকর করে তুলছে। সম্পদের কেন্দ্রীভবন, বৈষম্য বিকাশ, প্রাণ-প্রকৃতির বিনাশ পঞ্চাশ বছরের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যাদের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, তারা যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। কারণ যেভাবে তারা সম্পদ কেন্দ্রীভূত করছে, গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতার প্রক্রিয়ায় এটা সম্ভবই নয়।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।