স্বতন্ত্র এমপিদের তোপের মুখে নৌকার কর্মীরা


দলীয় প্রতীক নৌকার পক্ষে নির্বাচন করে চাপে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী। বেশ কয়েকটি আসনে স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যের ক্ষমতার কাছে অসহায় তারা। নির্বাচনের তিন মাস পরও বন্ধ হয়নি হামলা, মামলা, মারধর। নির্যাতনের ভয়ে এখনও এলাকা ছাড়া অনেকে। দলীয় পদ-পদবিতে থাকলেও সক্রিয় হতে পারছেন না স্থানীয় রাজনীতিতে। নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে তাদের। প্রায় এক ডজন সংসদীয় এলাকায় খোঁজখবর নিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এসব এমপির লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ চান তৃণমূল নেতারা। তবে নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট এমপিরা। তাদের দাবি-রাজনৈতিক কারণেই এমন অভিযোগ তোলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে দায়ীদের বিরুদ্ধে। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই আওয়ামী লীগের প্রাণ। দুর্দিন এবং দুঃসময়ে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলকে সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী করে। তাদের ত্যাগ ও পরিশ্রমে আজ আওয়ামী লীগ টানা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে। যারা অন্যায় ভাবে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের আঘাত, নির্যাতন, ঘরবাড়ি ছাড়া করবে আওয়ামী লীগে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে। এসব বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সত্যতা পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান পরিষ্কার। ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। বিএনপি ও তাদের শরীকদের বর্জনের এ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ করতে দলের নেতাদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের সুযোগ দেয় আওয়ামী লীগ। এমন সিদ্ধান্তে রেকর্ডসংখ্যক (৬২) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান। ভোটের মাঠে তাদের কাছে দলের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতারাও পরাজিত হন। তবে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। বিশেষ করে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মাঠে থাকায় তৃণমূলে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব কোন্দল। সংঘাত-সহিংসতা, হামলা-পালটা হামলা, মারধরসহ প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। এই সমস্যার জের কাটেনি এখনো। বেশকিছু জায়গায় নৌকার নির্বাচন করা নেতাকর্মীরা আছেন স্বতন্ত্র এমপি ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের চাপে। অনেকে যেতে পারছেন না এলাকায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়-দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালের কাছে পরাজিত হন নৌকার মনোনীত প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের মক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস। তিনি ভোটে হারার পরে নির্যাতনের শিকার হন তার কর্মী-সমর্থক এবং অনুসারীরা। মারধর ও হামলার ভয়ে এলাকা ছাড়া হন দলের প্রায় শতাধিক নেতা। এখনও বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও হত্যার ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে দাবি তাদের। মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মকবুল হোসেন বলেন, সংসদ নির্বাচনের পর থেকে আমি ঘরবন্দি। দলীয় কর্মসূচি দূরের কথা, বাইরেও যেতে পারি না। পুলিশের সহযোগিতায় ঈদের নামাজ পড়েছি। আতঙ্কে থাকি কখন যে বাড়িতে হামলা হয়। নির্বাচনের পর অনেকটাই ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে সময় যাচ্ছে। আমার অপরাধ নৌকার নির্বাচন করেছি। তিনি আরও বলেন, সারা জীবন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলাম। বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হলাম। এখন দল ক্ষমতায়। অথচ দলীয় প্রতীক নৌকার নির্বাচন করায় বিপদে আছি। জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে এলাকা ছাড়া মুন্সীগঞ্জ জেলা জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল কাশেম। তিনি বলেন, নৌকার নির্বাচন করেছিলাম। এটাই আমার অপরাধ। তারা (স্বতন্ত্র এমপির কর্মী-সমর্থক) আমাকে দেখলেই আক্রমণ করে। এ কারণে নির্বাচনের পর থেকে আমি বাড়িঘর ছাড়া। কোনোভাবেই এলাকায় যেতে পারছি না। রাজনীতি করতে পারছি না। তার ভাষ্যমতে, মুন্সীগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী বর্তমানেও এলাকা ছাড়া রয়েছেন। তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ-সদস্য (স্বতন্ত্র এমপি) মোহাম্মদ ফয়সাল। তিনি বলেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। সবাই নিজ নিজ স্থানেই আছেন। এসব অভিযোগের সত্যতা আছে বলে মনে করি না। নৌকার নির্বাচন করে তোপের মুখের রয়েছেন নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের নৌকার সমর্থকরা। নির্বাচনের পর থেকে হামলার শিকার হচ্ছেন তারা। ভয়ে বাড়ি ছাড়া অনেকে। লালপুর উপজেলার চন্দপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেম্বর মিজানুর রহমান বলেন, অপরাধ নৌকার নির্বাচন করেছি। কেন নৌকার নির্বাচন করলাম? কেন নৌকার পক্ষে ভোট চাইলাম? এজন্য মারধরের শিকার হলাম। প্রতিদিন শঙ্কায় থাকি, যে কোনো মুহূর্তে আমার ওপর আবার হামলা হতে পারে। নাটোর-১ আসনে নৌকার মনোনীত প্রার্থী ছিলেন সাবেক এমপি শহিদুল ইসলাম বকুল। তিনি বলেন, নির্বাচনের পরপরই নৌকার কর্মী-সমর্থকদের হামলা করেছেন স্বতন্ত্র এমপির সমর্থকরা। অনেক বাড়িঘর ও দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়েছে। তার (বর্তমান এমপি) নিজ ইউনিয়নের কিছু নেতাকর্মী এখনও বাইরে পালিয়ে আছে। তিনি বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। বিষয়গুলো নিয়ে দলের হাইকমান্ডের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে নির্বাচনের আগে-পরে নির্বাচনি এলাকার এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই বলে দাবি করেন স্থানীয় সংসদ-সদস্য আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, এই প্রথম আপনার মুখে (সাংবাদিক) শুনলাম। আমি এর আগে কখনই এমন ঘটনা শুনিনি। সংসদ নির্বাচনে নৌকার কাজ করায় বিপদে পড়েছেন কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী ও খোকসা) আসনে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। এখানে স্বতন্ত্রের ব্যানারে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আবদুর রউফ। তিনি নৌকার সমর্থিত প্রার্থী সেলিম আলতাফ জর্জকে ভোটের মাঠে পরাজিত করেন। নির্বাচনের পর বেশ কয়েক দফা দুপক্ষের সংঘাত সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। নির্বাচনের পর গত তিন মাসে দুপক্ষের তিনজন খুন হয়েছেন। সর্বশেষ মার্চের শেষদিকে স্বতন্ত্র এমপি ও নৌকার সমর্থকদের মাঝে সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এমন অবস্থায় দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কুমারখালীর কয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, নৌকার মনোনীত প্রার্থীর নির্বাচন করলাম। এখন নির্যাতনের শিকার হচ্ছি। নৌকার কর্মী-সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হচ্ছে। নির্যাতনের ভয় দেখানো হচ্ছে। মাঝে মধ্যেই সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আতঙ্কে অনেকে বাড়ি ছাড়া। দিন দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব দুঃখ বলার ভাষা নেই। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও সংসদ-সদস্য আবদুর রউফের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। কিশোরগঞ্জ-২ (পাকুন্দিয়া-কটিয়াদী) আসনে নৌকার মনোনীত প্রার্থী আব্দুল কাহার আকন্দ হারের পরই চাপে মুখে পড়েন তার কর্মী-সমর্থকরা ও অনুসারীরা। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নানা ভাবে তাদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে স্বতন্ত্রের ব্যানারে নির্বাচিত এমপি সোহরাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে। আব্দুল কাহার আকন্দ বলেন, নির্বাচনের পর আমার অনেক কর্মী-সমর্থক মার খেয়েছেন। অনেকের ঘরবাড়িতে হামলা করা হয়েছে। নির্বাচনের পর এতদিনেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আর স্থানীয় সংসদ-সদস্য সোহরাব উদ্দিন বলেন, গত নির্বাচনে আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে প্রার্থী হওয়া এবং নির্বাচন করার সুযোগ দিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে যারা নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন তারা আওয়ামী লীগের, যারা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন তারাও আওয়ামী লীগের। সবাই যেহেতু আওয়ামী লীগের-তা হলে আমি কেন তাদের হয়রানি করব? যারা নৌকার নির্বাচন করেছেন, তাদের কোনো চাপেই রাখা হয়নি। দলের একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছেন। নরসিংদী-৩ আসনে নৌকার মনোনীত প্রার্থী ফজলে রাব্বি খানের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই হামলার শিকার হন নৌকা মনোনীত প্রার্থী ও তার কর্মী-সমর্থকরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফজলে রাব্বি খান বলেন, এখন পরিবেশ মোটামুটি ভালো রয়েছে। তবে যারা নৌকার নির্বাচন করেছেন? মিছিল মিটিং করেছেন। তাদের এমপি সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছেন। অভিযোগ বিষয়ে সংসদ-সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করলেও আমি আওয়ামী লীগের লোক। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দলের কাউকে চাপে রাখিনি। নৌকার নির্বাচন করায় কাউকে বঞ্চিতও করছি না। সবাইকে সমানভাবে মূল্যায়ন করছি। এগুলো নিয়ে এসব অভিযোগের সত্যতা নেই।