অস্বাভাবিক নিচে পানির স্তর, তীব্র পানি সংকটে বরেন্দ্র অঞ্চল


রাজশাহী জেলাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে তপ্ত-উত্তপ্ত বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট ভয়াবহ আকার নিয়েছে। অঞ্চলের কোথাও হস্তচালিত নলকূপে এক ফোটাও পানি উঠছে না। চলমান তাপপ্রবাহ ও তীব্র খরার মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে অবস্থান করছে। পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে হাহাকার উঠেছে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে। এদিকে এলাকায় পানিস্তর নিচে নেমে এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার সংকট নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি বিশেষ পোস্ট দিয়েছেন রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি লিখেছেন, ‘বাঘা-চারঘাট এলাকায় পানি পেতে সমস্যা হচ্ছে মানুষের। এরপরও গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে। অতিরিক্ত পুকুর খনন করে গভীর নলকূপ বসিয়ে পুকুরে পানি ভরা হচ্ছে। এলাকায় পানিস্তর দ্রুত নেমে যাওয়ার এটা বড় কারণ বলে আমার মনে হচ্ছে।’ সরকারের সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর পোস্টে মন্তব্য লিখেছেন কয়েকশ মানুষ; যারা নিজ নিজ এলাকার পানি সংকটের কথা তুলে ধরেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর সর্বত্রই তীব্র পানি সংকট বিরাজ করছে। রাজশাহী বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আশি ও নব্বই এর দশকে রাজশাহী অঞ্চলের গ্রাম জনপদে হাজার হাজার হস্তচালিত নলকূপ স্থাপন করা হয় পানি চাহিদা মিটাতে। এমন কয়েক লক্ষাধিক হস্তচালিত নলকূপে এখন আর পানি উঠে না। ভূ-গর্ভস্থ পানি স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপই এখন প্রায় পরিত্যক্ত। ক্রমাগত পানি চাহিদা সংকট মিটাতে এখন গ্রামাঞ্চলে সাবমারসিবল পাম্প বরাদ্দ ও স্থাপন করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জল মোটর দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই নিজের টাকায় জল মোটর স্থাপন করছে। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর এলাকায় ওয়াসার সরবরাহ পানি পেয়ে থাকে এলাকাবাসী। রাজশাহী মহানগর এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনে উচ্চ ক্ষমতার পানির পাম্প। নগরীতে ব্যক্তি উদ্যোগে ৬ হাজারের বেশি সাবমারসিবল পাম্প রয়েছে। নগরীতে থাকা হস্তচালিত নলকূপগুলো থেকে এখন আর কোনো পানি পাচ্ছে না নগরবাসী। অন্যদিকে রাজশাহী অঞ্চলের গ্রাম জনপদে থাকা হস্তচালিত নলকূপেও কোনো পানি উঠছে না। তানোরের মুণ্ডুমালা পৌরসভার মেয়র সাইদুর রহমান জানান, শুষ্ক মৌসুমে বরেন্দ্র এলাকায় পানির সংকট বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে এলাকার মানুষের পানির প্রাপ্তির প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে বিএমডিএর গভীর নলকূপ ও পুকুর। তাও লোকজনকে অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। পানি সংগ্রহের কষ্টটাই এখন এলাকার মানুষের কাছে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানা গেছে, এপ্রিল-মে মাসে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রাম জনপদে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে যায় প্রতি বছর। গত কয়েক বছর ধরে এমনটা দেখা যাচ্ছে। এ বছর পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে রাজশাহী অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা ঊর্ধ্বে ৪০ এবং নিম্নে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে উঠানামা করছে। এই সময়ে বরেন্দ্রভুমির মাঠ ঘাট পুকুর জলাশয় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ওয়ারপো নামের একটি পানি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে রাজশাহীর পাঁচন্দর ইউনিয়ন হচ্ছে দেশের সবচেয়ে উত্তপ্ত এলাকা। এই এলাকায় পানির সংকটও বেশি। এলাকার বাসিন্দা সাজেদুল ইসলাম বলেন, পানি সংকটের কারণে গরু বাছুর পালন করা কঠিন হয়ে উঠেছে। ১৫০ ফুট বোরিং করেও টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকার পুকুর জলাশয়েও পানি নেই। আর খাওয়ার পানির কষ্ট আরও বেশি। যখন বিদ্যুৎ থাকে তখন বিএমডিএর গভীর নলকূপ চালু হয়। তখন গ্রামবাসী কলস বালতি গামলা পাত্র নিয়ে একযোগে ভিড় করেন পানি সংগ্রহ করতে। কাড়াকাড়ি করে পানি সংগ্রহ করতে হয় গ্রামের শতাধিক পরিবারকে। এক অসহনীয় কষ্টের বিষয়। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, জেলার তানোর উপজেলার মুণ্ডুমালা পৌরসভার মাহালিপাড়া গ্রামের মানুষের এখন পানির সঙ্কট ভয়াবহ আকার নিয়েছে। মাহালিপাড়া বাসিন্দা আদিবাসী ফিলিপ টুডু বলেন, অনেক মানুষে নিজের পয়সায় সাবমারসিবল বসিয়ে পানির চাহিদা মেটাচ্ছে; কিন্তু আমরা গরিব মানুষ। একটা সাবমারসিবল বসাতে লাখ টাকা খরচ হয়। আমরা পারি না। বিএমডিএর গভীর নলকূপই আমাদের একমাত্র ভরসা। সারাদিন বিদ্যুৎ বন্ধ থাকলে আমরা নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে বসে থাকি। রাজশাহীর তানোরের পাশাপাশি গোদাগাড়ীর বরেন্দ্র ভূমির গ্রামগুলোতেও তীব্র পানি সংকট বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। গোদাগাড়ীর ললিতনগর এলাকার বাসিন্দা মনজুর হোসেন বলেন, আগে মানুষ খাওয়ার চিন্তা করতেন। এখন এলাকার মানুষের বড় চিন্তা হয়ে উঠেছে খাওয়ার পানি। পানির অভাবে এলাকাবাসী গরু ছাগল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে রাজশাহীর পদ্মা তীরবর্তী গ্রামগুলোর কোনো টিউবওয়েলে পানি উঠছে না বলে জানিয়েছেন বাঘার গড়গড়ি এলাকার বাসিন্দা জায়েদা খাতুন। তিনি বলেন, এপ্রিল মাস শুরু হওয়ার পর টিউবওয়েলে পানি নেই। এক ঘণ্টা চেষ্টা করেও এক বালতি পানি তোলা যাচ্ছে না। এখন প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে পানি এনে খেতে হচ্ছে। বাঘার উত্তর মিলিক বাঘা গ্রামের নাসির উদ্দীন বলেন, বাড়ির টিউবওয়েলে ১৭০ ফুট পাইপ বসিয়েছি। এরপরেও পানি উঠছে না। বিদ্যুৎচালিত মোটর বসানো আছে, সেখানেও পানি উঠছে না। সংকট ভয়াবহ। অন্যদিকে তীব্র খরায় বরেন্দ্রভূমিতে বোরো ক্ষেতে সেচ সংকট বেড়ে গেছে। বিএমডিএর গভীর নলকূপগুলো থেকে কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী পানি দিতে পারছে না। রাজশাহী জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ বলেন, প্রতি বছরই এপ্রিল-মে মাসে বরেন্দ্রের পানিস্তর নেমে যায়। বৃষ্টি হলে তখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। রাজশাহীর আবহাওয়া এখন বেশ উত্তপ্ত। এপ্রিলজুড়ে খরা চলছে। গ্রামাঞ্চলে পানির কিছুটা সংকট আছে বলে আমরা অভিযোগ পাচ্ছি। বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতি বছর অব্যাহতভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে যাচ্ছে উল্লেখ করে রাবির ভূতত্ত্ব ও খনি বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব রাজশাহী অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে। আবার বৃষ্টি কম হওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারও এজন্য অনেকাংশে দায়ী। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হতে পারে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানো। এতে স্থিতিশীল একটা অবস্থা আসতে পারে।