ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে


গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারিকৃত ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত সার্কুলার নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকসংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রচণ্ড আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। সার্কুলারটি মূলত ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নতকরণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। ‘ইচ্ছাকৃত ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ও চূড়ান্তকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা’ শীর্ষক এ প্রজ্ঞাপনে শিডিউল ব্যাংকগুলোকে এমন কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যা অতীতে আর কখনোই দেওয়া হয়নি। এ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান তুলে ধরেছে। ব্যাংক খাতে বিদ্যমান পর্বতপ্রমাণ খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের নানাভাবে সুবিধা দিয়েছে, অর্থনীতিবিদরা নানাভাবে এর সমালোচনা করেছেন। সেই বাংলাদেশ ব্যাংক হঠাৎ করেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে এতটা কঠোর হতে যাচ্ছে কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের অনুমোদন পেয়েছে। ইতোমধ্যে অনুমোদিত ঋণের প্রথম কিস্তি বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ করা হয়েছে। আইএমএফ ঋণদানের শর্ত হিসাবে ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিল। অনেকের ধারণা, আইএমএফের শর্ত পরিপালনের স্বার্থেই বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। যে কারণেই হোক, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণ অবশ্যই ভালো একটি উদ্যোগ। কারণ দেশের ব্যাংক খাতের আজ যে দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ভূমিকা অনেক। তাই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি-যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করে আটকে রাখে। ব্যাংক খাতে দুই ধরনের ঋণখেলাপির উপস্থিতি বা অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। এদের মধ্যে একটি শ্রেণি নানা প্রতিকূলতার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সামর্থ্যরে অভাবে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারে না। এরা প্রকৃত ঋণখেলাপি। আর যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নানাভাবে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করে আটকে রাখে, তারা হচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। প্রকৃত ঋণখেলাপিদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা গেলেও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া ঠিক নয়। সার্কুলারে বলা হয়েছে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি ঋণ পরিশোধ না করলে এবং জালিয়াতি, প্রতারণা, বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ গ্রহণ করলে তিনি বা সে প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে আখ্যায়িত হবেন। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দুই ধাপ নিচের একজন কর্মকর্তার অধীনে একটি পৃথক ইউনিট গঠন করতে হবে ৯ এপ্রিলের মধ্যে। নতুন করে কোনো গ্রাহক ঋণখেলাপি হলে সে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি কি না, তা ৩০ দিনের মধ্যে যাচাই করতে হবে। কেউ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য প্রদানের জন্য ১৪ দিনের সময় দিয়ে চিঠি দেওয়া হবে। ঋণগ্রহীতার বক্তব্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে না হলে অথবা তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য উপস্থিত না হলে ব্যাংক এককভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার বিষয়টি অবহিত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ৭ দিনের মধ্যে চিঠি দিয়ে জানাতে হবে। সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতা যদি ক্ষুব্ধ হন, তাহলে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আপিল করতে পারবেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। যিনি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন, তিনি কোনো ধরনের সুদ মওকুফ সুবিধা পাবেন না। তার ঋণ হিসাব পুনঃতফশিল করা যাবে না। ঋণের অর্থ পুরোপুরি শোধ না হওয়া পর্যন্ত তিনি খেলাপি হিসাবেই চিহ্নিত থাকবেন এবং এ সময়ের মধ্যে অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশ ভ্রমণ ও ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা নতুন কোনো কোম্পানি খুলতে পারবেন না। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাবেন না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা গাড়ি, বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তার কাছে পাওনা পুরো ঋণের অর্থ পরিশোধ করলেও তিনি পাঁচ বছর পর্যন্ত কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নিযুক্ত হতে পারবেন না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা তাদের কাছে পাওনা অর্থ ব্যাংকের অনুকূলে পরিশোধ না করলে অর্থ আদায়ের জন্য ব্যাংক উপযুক্ত আদালতে মামলা করতে পারবে। খেলাপি ঋণ আদায়, বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ছাড়া এ ধরনের উদ্যোগ কখনোই কার্যকর ও সফল হতে পারে না। আইন প্রণীত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য। কিন্তু ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইনি সংস্কার করা হয়েছে তার অধিকাংশই ঋণখেলাপি এবং অসৎ মানুষের স্বার্থরক্ষায় নিবেদিত। কাজেই এসব আইনি সংস্কার বাতিল না করা হলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগই বাস্তবায়িত হবে না। ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণের জন্য সাধারণত রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং আর্থিক ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। যেসব কোম্পানি বৃহৎ অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করেছে, তাদের কজন বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, ঋণ গ্রহণকালে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা অথবা অবৈধ অর্থ ব্যয় করেননি? ব্যাংক ব্যবস্থায় অবৈধ অর্থ ব্যয় করলে রাতকে দিন এবং দিনকে রাতে পরিণত করা যায়। ব্যাংক এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সব সময়ই সরকারি দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে চলেন। ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তা ছাড়া কোনো খারাপ ঋণ সৃষ্টি হতে পারে না। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যদি সঠিকভাবে মূল্যায়ন এবং যাচাই-বাছাই করা হয়, তাহলে কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে যেনতেন ধরনের ঋণ গ্রহণ করতে পারেন না। অনেক সময় তৃণমূল পর্যায়ের কর্মকর্তারা চাইলেও উপরের কর্মকর্তার নির্দেশে অনুপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ প্রদানের প্রস্তাব সমর্থন করতে বাধ্য হন। যদি এ পর্যায়ে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণ করতে হয়, তাহলে প্রথমেই সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক আইনে যেসব পরিবর্তন করা হয়েছে তা বাতিল করতে হবে। কয়েক বছর আগে ২ শতাংশ নগদ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুনঃতফশিলীকরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। একটি সূত্র মতে, ৩৮ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ সুযোগ গ্রহণ করে তাদের ঋণ হিসাব পুনঃতফশিলীকরণ করেছেন। যারা এ সুযোগ গ্রহণ করে তাদের ঋণ হিসাব পুনঃতফশিলীকরণ করেছেন, তাদের বেশির ভাগই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি এবং রাজনৈতিকভাবে প্রচণ্ড প্রভাবশালী। এই ৩৮ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংক আইন অনুসারে ঋণখেলাপি নন। তাহলে কীভাবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করা হবে? এদের তো ঋণখেলাপি অভিধায় অভিহিত করা যাবে না। ঋণ হিসাব পুনঃতফশিলীকরণ হচ্ছে কার্যত ঋণগ্রহীতাদের ঋণখেলাপির ‘তকমা’মুক্ত করার একটি নিন্দনীয় কৌশলমাত্র। জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় কোনো নির্বাচনে কোনো ঋণখেলাপি অংশগ্রহণ করতে পারেন না। কিন্তু দেখা যায়, নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ হিসাব নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিয়মিতকরণ করে নেন। ফলে তাদের আর নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। কাজেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত করতে হলে ঢালাওভাবে ঋণ হিসাব পুনঃতফশিলীকরণ বন্ধ করতে হবে। ঢালাওভাবে খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃতফশিলীকরণ বন্ধ করা না হলে তারা আইনের ফাঁক গলিয়ে নিজেদের বের করে নিয়ে যাবেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দুই ধাপ নিচের একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি টিম ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণের প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু যারা এ দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের মধ্যে যদি এমন কেউ থাকেন যিনি সংশ্লিষ্ট ঋণ অনুমোদনের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, তাহলে কি তিনি সেই ঋণ হিসাবধারীকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করতে চাইবেন? এতে তার দায়বদ্ধতার প্রশ্ন এসে যাবে। ব্যাংকের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ঋণগ্রহীতাদের নানাভাবে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে থাকে। এই কর্মকর্তারাই ঋণগ্রহীতাকে বলে দেবে কীভাবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার তালিকা থেকে মুক্ত থাকা যাবে। সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সত্যিই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করতে চায়, তাহলে প্রথমেই দৃঢ় রাজনৈতিক কমিটমেন্ট গ্রহণ করতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তারা যাতে কোনো রাজনৈতিক দলের আশ্রয় গ্রহণ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি একজন বিচারপতির নেতৃত্বে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণ এবং বকেয়া ঋণ আদায়ের জন্য স্বাধীন ও শক্তিশালী কমিশন গঠন করা যেতে পারে। পরীক্ষিত, সৎ ও দক্ষ লোকবলের সমন্বয়ে এ কমিশনকে সাজানো যেতে পারে, যারা নির্মোহভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা ঋণ অনুমোদনকালে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপের দায় শুধু ঋণগ্রহীতার একার নয়। ব্যাংক কর্মকর্তাও এই দায়ে দায়ী। এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক