‘উজ্জ্বল বাংলাদেশ’ নয় কেন?


সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোনো এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তার এ আশাবাদ নিঃসন্দেহে একটি স্বপ্নময় প্রত্যাশা এবং আগামী দিনের বাংলাদেশ সেরূপ স্বপ্নের আলোকে গড়ে উঠুক-এটি সাধারণ মানুষেরও আন্তরিক কামনা। বাংলাদেশের সামাজিক-সংস্কৃতির সাম্প্রতিক ধারা মেনে দেশের ব্যাপক সংখ্যক মানুষ যেমন বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও হয়তো বক্তৃতা করতে গিয়ে তেমনিভাবে ইংরেজি ‘স্মার্ট’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, স্মার্টের একাধিক উপযুক্ত ও চমৎকার বাংলা প্রতিশব্দ থাকা সত্ত্বেও বক্তৃতায় প্রকাশিত তার এ দৃষ্টিভঙ্গিটি বোঝানোর জন্য তিনি এ ইংরেজি শব্দটিকেই হুবহু রেখে দিতে বলেছেন। বরং বাংলাভাষার প্রতি তার যে অগাধ মমতা এবং আমাদের জানা মতে এ ভাষাকে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে তার যে অসীম আকাঙ্ক্ষা, তাতে করে স্মার্টের পারিবর্তে একটি উপযুক্ত ও জুতসই বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করলে, ধারণা করা যায় যে, তিনিই সর্বাধিক খুশি হবেন। কিন্তু সদা চাটুকারিতায় অভ্যস্ত একশ্রেণির আধা-শিক্ষিত লোক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ সংক্রান্ত অন্তর্গত চেতনা ও মর্মার্থকে উপলব্ধি না করে এটিকে একটা প্রচারসর্বস্ব স্লোগানে রূপান্তর করে ফেলার কাজে লিপ্ত রয়েছেন। এতে করে একদিকে যেমন বাংলাভাষার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও এতে বিব্রত হচ্ছেন বলে আমাদের ধারণা। মুখের বক্তৃতার কথাবার্তাকে লেখ্যভাষার আনুষ্ঠানিকতা দিতে গিয়ে উপযুক্ত প্রমিত শব্দ ব্যবহার করাটাই বিশ্বজনীন রীতি। এ সমকালীন বাংলাদেশেও রাজনীতিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, আমলা প্রমুখেরা যখন নানা অপ্রমিত কথ্য শব্দ ব্যবহার করে বক্তৃতা করেন, তা কিন্তু পরক্ষণেই প্রমিত শব্দ ও বাক্যে পুনর্গঠিত হয়ে আনুষ্ঠানিক গদ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কিংবা ওইসব বক্তৃতার সার কথাগুলোকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমে প্রেরণের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন নিজেরাই সেগুলোকে আনুষ্ঠানিক গদ্যে রূপান্তর করে দেন। এসব ক্ষেত্রে কখনোই তারা বক্তৃতায় ব্যবহৃত কথ্য, অপ্রমিত বা ইংরেজি শব্দগুলোকে হুবহু বহাল রাখেন না। সক্রেটিস, ভলতেয়ার কিংবা রুশোর কাছ থেকে পাওয়া অনেক শ্রুতিকথাই আমাদের কাছে এখন আনুষ্ঠানিক গ্রন্থের বাক্যসমষ্টি। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের আঞ্চলিক ভাষার অনেক কথোপকথনই এখন প্রমিত বাংলায় রূপান্তরিত হয়ে বোদ্ধা পাঠকের আগ্রহের বিষয়বস্তু। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোনো অবস্থাতেই ইংরেজি ‘স্মার্ট’ শব্দটিকে বাংলায় লিখন বা যোগাযোগের সময় ‘স্মার্ট’ আকারে রেখে দিতে বলেননি। অপ্রয়োজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙানোর একটি রীতি সাম্প্রতিক বাংলাদেশকে অনেকটাই যেন আগ্রাসী ভঙ্গিতে গ্রাস করে ফেলেছে। ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত একজন খুদে সরকারি কর্মচারীকেও দেখি কথায় কথায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিতে, যার সঙ্গে দাপ্তরিক শিষ্টাচার অনুযায়ী কখনোই এবং কোনোদিনই প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ বা সাক্ষাৎ হওয়ার কথা নয়। গত রোববারের দৈনিক পত্রিকায় দেখলাম একজন জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট সংবাদ প্রতিবেদককে বলছেন যে, ‘দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলকে রক্ষার জন্য এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে’ (বণিক বার্তা, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। এখন কথা হচ্ছে, চলনবিলের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার দায়িত্ব তো কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এবং স্থানীয় পর্যায়ে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার কর্র্তৃপক্ষের। ফলে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের তো যোগাযোগ হওয়ার কথা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে সাধারণভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার যোগাযোগ হওয়ার কোনো কারণই নেই। অথচ তিনি বলছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা। অন্যদিকে চলনবিলের পরিবেশসংক্রান্ত বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পরিবেশ ও মন্ত্রণালয়কে দেওয়াই আছে। কিন্তু তারপরও যদি তারা সে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে কাজে না লাগিয়ে এ বিষয়ে অপ্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হন, তাহলে বুঝতে হবে, এ বিষয়ে তারা নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে অপ্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্বভারাক্রান্ত করছেন। তারা বুঝতেই চান না, দেশের একজন প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়ে সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতে হয়। এ অবস্থায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ই যদি এভাবে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে প্রায় প্রতিটি বিষয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা, পরামর্শ, মতামত, অনুশাসন ও সিদ্ধান্তের জন্য পাঠান, তাহলে তিনি রাষ্ট্রের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর জন্য গুণগত মনোযোগ ও সময় দেবেন কেমন করে? তাছাড়া এটি মন্ত্রণালয়গুলো কর্তৃক দায়িত্ব এড়ানো বা দায়িত্বে ফাঁকি দেওয়ার শামিলও বৈকি! ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’কে যে কেউ দায়িত্ব নিয়ে ‘চৌকশ বাংলাদেশ’ ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ বা ‘উজ্জ্বল বাংলাদেশ’ শব্দগুচ্ছে রূপান্তর বা সে হিসাবে তা ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন না, এটিও সেই একই ধারার দায়িত্ব এড়ানোর আরেকটি উদাহরণ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে দেশের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী বা ভাষাবিদদেরও একটি দায়িত্ব ছিল, যা তারা পালন করেননি। আসলে স্মার্ট বাংলাদেশ কথাটির মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অনুমান করি, এমন এক বাংলাদেশের কথা বোঝাতে চেয়েছেন, যেখানে বিশ্ব দরবারে এ দেশ ও তার মানুষেরা অপরাপর দেশের মানুষ ও সমাজের তুলনায় শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি, সমাজ-সভ্যতা ও রাজনীতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ও ভোটাধিকার ইত্যাদি সবকিছুতেই এতটা এগিয়ে থাকবে যে, অন্যেরা তা দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে। আর বাংলাদেশের সার্বিক চেহারা তখন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে এবং লোকে তা দেখে বলবে, এ হচ্ছে এক ‘উজ্জ্বল বাংলাদেশ’, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এ দেশের ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের নেতাকর্মীরা, সত্তরের নির্বাচনের ভোটদাতারা, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদেরা, বাহাত্তরের সংবিধান প্রণেতারা, এমনকি নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখার নির্মাতারাও। কিন্তু সে রকম একটি উজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়ার জন্য সম্মিলিত প্রয়াস ও প্রস্তুতি কি আমাদের রয়েছে? ভাষাগতভাবে বাংলার এখন খুবই বেহাল দশা। এর উন্নয়ন, প্রসার ও গবেষণার জন্য তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। আর দৈনন্দিন ভাষাচর্চার অবস্থা তো করুণের মধ্যেও আবার করুণতর। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের পাঠদান থেকে শুরু করে টেলিভিশনের টকশো ও অন্যান্য অনুষ্ঠান কিংবা সভা-সেমিনার-কর্মশালার গুরুগম্ভীর আলোচনা থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদের রাষ্ট্রিক আলোচনা পর্যন্ত, সর্বত্রই বাংলা-ইংরেজি মেশানো এমন জগাখিচুড়ি ভাষার প্রবর্তন আমরা করে ফেলেছি যে, তাকে আর যাই হোক বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি বলা যায় না কিছুতেই। বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের মানও ক্রমশ নিম্নগামী। বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলা উপলক্ষ্যে শত শত বই প্রকাশিত হচ্ছে বটে। কিন্তু এগুলোর বিষয়বস্তু ও ভাষাগত মান দেখে বলতেই হয় যে, মুদ্রণ প্রযুক্তির সহজলভ্যতার সুযোগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখকের নিজের পয়সায় প্রকাশিত এসব বইয়ের বেশির ভাগ না বেরোলেই বরং পাঠকের অধিক উপকার হতো। এ অবস্থায় বাংলা গ্রন্থের অভাব পূরণে বিশ্বস্বীকৃত নানা ধ্রুপদী গ্রন্থের মানসম্মত বাংলা অনুবাদও যদি প্রকাশিত হতো, তাহলেও একদিক থেকে তা ভালো ছিল। তো এই যখন বাংলাভাষা, সাহিত্য ও ভাষাজাত সংস্কৃতির সর্বশেষ বেহাল ও করুণ দশা, তখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’কে যদি অন্তত ‘উজ্জ্বল বাংলাদেশ’, ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ কিংবা ‘প্রগতির বাংলাদেশ’ নাম দিয়ে নিরক্ষর বা প্রায় নিরক্ষর সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যেত, তাহলে স্বাধীনতার মাসে অন্তত একটি প্রতীকী ভালো কাজ হতো বলে মনে করি। আবু তাহের খান : গবেষক ও প্রাবন্ধিক