প্রশাসনে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি


সুশাসনের প্রধান ও অন্যতম অন্তরায় বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি যে রাষ্ট্রে প্রাধান্য পায়, সেই রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও সুশাসন নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। কারণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে বিতর্কহীন ও সর্বজনগ্রাহ্য আইনের প্রাধান্য। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সরকারের স্বার্থে নয়, বরং সর্বজনীন কল্যাণের স্বার্থে আইন প্রণয়ন এবং ওই আইনের পক্ষপাতহীন ও অনুরাগবিহীন প্রয়োগের মাধ্যমেই কেবল সুশাসন নিশ্চিত করা যায়। সুশাসন সর্বদাই নির্বাহী ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতাকে বর্জন করে এবং অনুরাগবিহীন বুদ্ধিমত্তা ও অভিলাষমুক্ত যুক্তিকে স্বীকৃত সত্য হিসাবে গ্রহণ করে। যে ক্ষেত্রে নির্বাহী বা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা ও অযৌক্তিকতা বিদ্যমান, সেক্ষেত্রে সুশাসন প্রত্যাখ্যাত হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে যদি কোনো আইনে জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষার অনুকূল কোনো বিধান সংযোজন করা হয়, তাহলে ওই আইনের প্রয়োগের দ্বারা কেবল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি করা যাবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি করা যাবে না। উদাহরণ হিসাবে সরকারি চাকরি আইন ও সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির উল্লেখ করা যায়। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্রে দুর্নীতি দমনকে আন্দোলন হিসাবে গড়ে তোলার এবং শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করার পূর্ববর্তী সময়ে বলবৎ আইনের বিধানমতে দুর্নীতির দায়ে দুদকের মামলায় কিংবা নৈতিক ঙ্খলনজনিত অপরাধে কোনো ফৌজদারি মামলায় যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ডে বা যে কোনো পরিমাণ জরিমানা দণ্ডে দণ্ডিত কর্মচারী চাকরি হারাতেন। কিন্তু সরকার কর্তৃক দুর্নীতি দমনকে আন্দোলন হিসাবে গড়ে তোলার এবং শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করার পরবর্তী পর্যায়ে জারিকৃত সরকারি চাকরি আইনে এমন বিধান রাখা হয়েছে, যাতে একজন কর্মচারী দুর্নীতির দায়ে দুদকের মামলায় বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে কোনো ফৌজদারি মামলায় এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে কিংবা কোটি টাকা জরিমানা দণ্ডে দণ্ডিত হলেও চাকরি হারাবেন না। এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করার পর বা কোটি টাকা জরিমানা পরিশোধ করার পর তাকে পূর্ব পদে বহাল করা বাধ্যতামূলক। এরূপ ক্ষেত্রে ওই কর্মচারীর ওপর কেবল তিরস্কার দণ্ড অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা অথবা নিম্নপদ বা নিম্ন বেতনস্কেলে অবনমিতকরণের মতো নমনীয় দণ্ড আরোপ করা যাবে, তাকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না। এ ধরনের বিধান জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্রের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ছাড়া বিশ্বের কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের আইনে এরূপ বিধান আছে কিনা জানা নেই। এরূপ অনৈতিক ও জনস্বার্থ পরিপন্থি আইনের বিধান প্রয়োগের দ্বারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি করা যাবে, কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি করা যাবে না। এছাড়া বিভাগীয় মামলায় কোনো কর্মচারী দুর্নীতিপরায়ণ হিসাবে প্রমাণিত হলে আগের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুযায়ী সর্বনিম্ন দণ্ড ছিল ‘চাকরি হতে বাধ্যতামূলক অবসর’। অর্থাৎ দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীকে চাকরিতে বহাল রাখার কোনো সুযোগ ছিল না। এরূপ ভালো বিধান পরিবর্তন করে নতুন প্রণীত শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিতে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীকে চাকরিতে কেবল বহাল রাখার সুযোগই রাখা হয়নি; উপরন্তু ‘তিরস্কার’ দণ্ড আরোপের মতো অতি নমনীয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এমনকি একাধিকবার দুর্নীতিপরায়ণ প্রমাণিত হওয়ার ক্ষেত্রেও ‘তিরস্কার’ দণ্ড আরোপের মতো নমনীয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ বিধি অনুসরণ করে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীকে ‘তিরস্কার’ দণ্ড প্রদান করা হলে আইনের শাসনের ব্যত্যয় হবে না, কেবল ব্যত্যয় হবে সুশাসনের। এছাড়া এরূপ বিধানের দ্বারা বিনষ্ট হচ্ছে জনপ্রশাসনের ভাবমূর্তি। দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের লালন করা কোনো সরকারের উদ্দেশ্য হতে পারে না। এসব নিয়ে অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও দুর্নীতির সহায়ক এরূপ বিধান বাতিল করা হয়নি। কিন্তু কেন, এটাই জনমনে প্রশ্ন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রে এমন একটা অবস্থা বিদ্যমান থাকতে হয়, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক আইনকে শ্রদ্ধা করে এবং প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে ও যৌথভাবে আইন মান্য করে এবং সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারও আইন মান্য করে এবং প্রশাসনও নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে আইন প্রয়োগ করে। এছাড়া সুশাসন নিশ্চিতের জন্য প্রশাসনের স্বৈরাচারী, অযৌক্তিক, একনায়কসুলভ ও স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপ বা আচরণ পরিহারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যে প্রশাসন বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে ‘শ্যাম’ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করে কৃত্রিম গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়, ওই প্রশাসনের আধিপত্য কৃত্রিম গণতান্ত্রিক সরকারের ওপর বেড়ে যায়। গণতান্ত্রিক শাসন রূপ নেয় ব্যক্তির শাসনে। ব্যক্তির শাসনে সর্বদাই সুশাসন উপেক্ষিত থাকে। এরূপ প্রশাসন নিজ বা গোষ্ঠী স্বার্থে সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজকেও ব্যাহত করে, যা সুশাসনের জন্য সহায়ক নয়। সুশাসনের আরেকটি উপাদান হচ্ছে, স্বেচ্ছাচারিতামূলক ক্ষমতার প্রভাবমুক্ত বিদ্যমান আইনের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বা প্রাবল্য এবং সরকারের স্বেচ্ছাচারিতামূলক, প্রাধিকারমূলক বা স্বেচ্ছাধীন ব্যাপক কর্তৃত্বের অনুপস্থিতি। সুশাসনের ক্ষেত্রে কোনো নির্বাহী কর্তৃপক্ষকে বা প্রশাসনকে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের কর্তৃত্ব প্রদানের সময় সুস্পষ্টভাবে কর্তৃত্বের সীমারেখা উল্লেখ করতে হয়। এরূপ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত অবশ্যই কোনো জ্ঞাত নীতি, বিধান ও পদ্ধতি অনুসরণে গ্রহণ করতে হয়। এছাড়া সিদ্ধান্তটি অবশ্যই জনসাধারণের পূর্ব ধারণাপ্রসূত হতে হয়। কোনো নীতি, বিধান ও পদ্ধতি অনুসরণে স্বেচ্ছাধীন কর্তৃত্ববলে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত না হয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির দ্বারা কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ওই সিদ্ধান্তটি অধারণাপ্রসূত এবং সুশাসনের পরিপন্থি সিদ্ধান্ত হিসাবে বিবেচিত হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি একটি জাতির জন্য মহামারির চেয়েও অধিক ক্ষতিকর। আর্থিক দুর্নীতি প্রমাণ করা যায় এবং আর্থিক দুর্নীতির বিচারও করা যায়। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি প্রমাণ করা যায় না এবং এর বিচারও করা যায় না। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ব্যবস্থায় মানবতার কল্যাণ, প্রকৃতির সৌন্দর্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার চেয়ে আর্থিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিবর্জিত হয় মানবতা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে আমরা কি বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা আশা করতে পারি না? মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইনবিষয়ক গ্রন্থের লেখক