ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বড় ঋণ জালিয়াতরা কি ইচ্ছাকৃত খেলাপি


বাংলাদেশ ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যেসব গ্রাহক আগে জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ নিয়েছেন, তাদের সবাইকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করার সুযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করে তাদের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। এ তালিকায় আলোচিত ঋণ জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোও পড়তে পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলও কোনো খেলাপিকে যথোপযুক্ত কারণ দেখিয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করার ক্ষমতা রাখে। ব্যাংক যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তা চূড়ান্ত করবে। এরপরই প্রচলিত আইন অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃত খেলাপির দায়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে বিমানে চড়া বন্ধ, ট্রেড লাইসেন্স, কোনো কোম্পানির নিবন্ধন, শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন না নেওয়া এবং বাড়ি, গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট কিনে নিবন্ধন করা আটকে দিতে পারেন। অর্থাৎ কোনো সম্পদ বা কোম্পানি গড়ে করা যাবে না নতুন ব্যবসা। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হওয়া যাবে না। কোনো ব্যাংক বিধি ভঙ্গ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ছাড় দিলে তাদের বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের জরিমানাসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। ১২ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি সার্কুলার জারি করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্ত করা এবং তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য একটি নীতিমালা ঘোষণা করেছে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ জালিয়াত বা প্রতারণা করে যারা ঋণ নিয়েছেন, তাদেরকে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করতে পারেন। এ কাজ শুরু করার জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দুই স্তর নিচের কর্মকর্তাদের দিয়ে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ইউনিট’ নামে একটি পৃথক ইউনিট ৯ এপ্রিলের মধ্যে গঠন করতে হবে। ৩০ জুন পর্যন্ত ঋণখেলাপিদের তথ্যের ভিত্তিতে ১ জুলাই থেকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি শনাক্ত করার কাজ শুরু করতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা অনুযায়ী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় কোনো গ্রাহক ঋণ জালিয়াতি করলেই তিনি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন। একই সঙ্গে ঋণের টাকা অন্য খাতে স্থানান্তর করলে, বন্ধকি জামানত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ছাড়া অন্যত্র স্থানান্তর করলে বা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করলেও ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি ও এনসিসি ব্যাংকের সাবেক এমডি এম. নূরুল আমিন বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপি শনাক্ত করাটা নির্ভর করবে ব্যাংকের ইউনিটের ওপর। এ বিষয়ে ইউনিটকেও ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ইউনিট কীভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করে, এটি এখন দেখার বিষয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে ওই ইউনিট ও ব্যাংকের ওপর নজর রাখা। যাতে তারা কোনো পক্ষপাতিত্ব করতে না পারে। তিনি আরও বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংজ্ঞা অনুযায়ী এখন ঋণ জালিয়াতি বা প্রতারণা করে যারা ঋণ নিয়েছেন, তারা ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকায় পড়বেন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ওই আইনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইনটি সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে সম্পদশালী কোনো ঋণখেলাপি থাকবে না। যাদের একেবারেই কিছুই নেই, তারা কেবল খেলাপির তালিকায় থাকতে পারেন। ফলে খেলাপি ঋণ অনেক কমে যাওয়ার কথা। সূত্র জানায়, ২০১২ সালে ব্যাংক খাতে ওই সময়ে সবচেয়ে বড় জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। হলমার্ক গ্র“প সোনালী ব্যাংকসহ ২৬টি ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে প্রায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আÍসাৎ করে। ওই ঋণের সবই এখন খেলাপি। কিছু ঋণ সোনালী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক অবলোপন করেছে। গ্রাহকের জামানতের বেশির ভাগই ছিল ভুয়া। ফলে সম্পদ বিক্রি করে ঋণ আদায় করা সম্ভব নয়। জালিয়াতির কারণে ওই গ্র“পের এমডি, চেয়ারম্যানসহ তিনজনে জেলে রয়েছেন। অনেক ব্যাংক কর্মকর্তাও জেলে। আইন অনুযায়ী হলমার্ক গ্র“পকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংক সূত্র জানায়, তারা আইন অনুযায়ী ওই গ্র“পের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। তবে গ্র“পের কর্ণধার সবাই জেলে বলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী নতুন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। কারণ, তাদের প্রায় সব ব্যবসাই বন্ধ। সরকারি খাতের একটি ব্যাংকসহ ৫টি ব্যাংকে ঘটেছে বিসমিল্লাহ গ্র“পের জালিয়াতি। এ গ্র“পের জালিয়াতি করা ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণের পুরোটাই এখন খেলাপি। এর সঙ্গে সুদ যোগ হয়ে খেলাপির পরিমাণ আরও বেড়েছে। পুরো অর্থই তারা বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। মামলা হলেও মালিক পক্ষের কেউ জেলে নেই। তারা সবাই পালিয়েছেন। আইন অনুযায়ী তারাও ইচ্ছাকৃত খেলাপি। এখন তাদেরকে দেশে আনতে পারলে অন্য ব্যবস্থাগুলো নেওয়া যায়। সরকারি খাতের একটি ব্যাংকে দুটি বড় গ্র“প ৫ হাজার কোটি টাকা করে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি করেছে। তাদের বেশকিছু ঋণ নবায়ন করা হলেও এ গ্র“পের ৫০ শতাংশের বেশি এবং অপর একটি গ্র“পের ৩০ শতাংশের বেশি এখনো খেলাপি। তারা এখনো ব্যবসা করছে। মালিকপক্ষ কেউ জেলে নেই। বিমানেও চড়ছেন। প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের ইচ্ছাকৃত খেলাপি করার সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে তাদের বিমান ভ্রমণ, নতুন কোম্পানি খোলা, বাড়ি-গাড়ি কিনে তা নিবন্ধ করা বন্ধ করার সুযোগ রয়েছে। বেসিক ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে শতাধিক প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে যাদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, তাদের প্রত্যেকেরই সম্পদ, বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা রয়েছে। এদেরও প্রচলিত আইন অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার সুযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় বড় বড় এক ডজন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিভিন্ন ব্যাংকে বড় অঙ্কের খেলাপি। এর মধ্যে এক গ্র“পের কাছেই খেলাপি ঋণ আড়াই হাজার কোটি টাকা। আরও কয়েকটি গ্র“পের কাছে দেড় হাজার কোটি টাকা করে খেলাপি ঋণ রয়েছে। জালিয়াতি করে ৮০০ কোটি টাকা আÍসাৎ করে দুই ভাই বিদেশে পালিয়ে গেছেন। তাদেরও ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করার সুযোগ রয়েছে। সরকারি একটি ব্যাংকসহ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে ঢাকার একটি ব্যবসায়িক গ্র“প প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি। ওই গ্র“পের বিভিন্ন সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। তাদেরকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। একটি টেক্সটাইল ও একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি সরকারি দুটি ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করে ঋণ নিয়ে এখন খেলাপি। একটি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে সাবেক একজন সংসদ-সদস্য এখন খেলাপি। ওই কোম্পানির পরিচালকরা এখন সব সুবিধা ভোগ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত খেলাপি আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের নতুন প্রজšে§র একটি ব্যাংক জালিয়াতির কারণে প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ প্যাকেজের আওতায় একে উদ্ধার করেছে। ওই ব্যাংক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতরা এখন সব ধরনের সুবিধাই ভোগ করছেন। তাদের বিরুদ্ধেও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সরকারি একটি ব্যাংকের রমনা শাখা থেকে জালিয়াতি করে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আÍসাৎ করা হয়েছে। এর সুবিধাভোগীরা এখনো ব্যবসা করছেন। একটি সরকারি ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখা ও মহিলা শাখায় জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া ঋণের প্রায় ৮০০ কোটি টাকা এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর সুবিধাভোগীরাও এখন ব্যবসা করছেন। এসব জালিয়াতদের বিরুদ্ধেও ইচ্ছাকৃত খেলাপি আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এছাড়া আরও অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণ জালিয়াতি করেছে। তারা বেনামে বা বিভিন্ন নামে এখনো ব্যবসা করছে। বিমানে চড়ছেন। তাদের বিরুদ্ধেও ওই আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।