রাজধানীতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে নিরীহ মানুষের পুড়ে অঙ্গার হয়ে মৃত্যুর ঘটনাগুলো অত্যন্ত বেদনাদায়ক। যারা অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়ে অঙ্গ হারিয়ে কোনোরকমে বেঁচে গিয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় জীবন অতিবাহিত করে চলেছেন, তা আরও বেশি হৃদয়বিদারক। কারণ, তাদের পঙ্গু জীবন নিজের ও পরিবারের কাছে কতটা কষ্টের বিষয়, সেটি শুধু ভুক্তভোগীর পরিবারই উপলব্ধি করতে পারেন। এসব কষ্টকর ঘটনা সংবাদ হয়ে সমাজ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিচ্ছে। প্রতিবছর রাজধানী ঢাকায় যখন-তখন, যেখানে-সেখানে বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা যেন নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকার প্রাকৃতিক বায়ুর গুণমান এতটাই নিু থাকে যে, প্রতিদিন সংবাদের শিরোনাম হওয়ায় সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে যে এটি বসবাসের নিকৃষ্টতম স্থান। আমরা সেসব সংবাদে চোখ বুলাই আর চোখ বুজে সহ্য করে যাই। কিন্তু কবছর ধরে বিভিন্ন কারখানা, গুদাম ও বহুতল আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের কারণে মর্মান্তিক মৃত্যুগুলো চোখ বুজে সহ্য করার শক্তিও হারিয়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হলো রেস্তোরাঁর টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে হঠাৎ মৃত্যুর হিমশীতল ডাকে সাড়া দেওয়ার মর্মন্তুদ ঘটনা; যা দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষাদের ছায়া ফেলে দিয়েছে। বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনের নিচতলার চায়ের দোকান থেকে সূত্রপাত সামান্য আগুন কেন এত বড় আকার নিল? কেন এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? রাজধানীর কেন্দ্রে আধুনিক অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা সচল থাকার পরও কেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে এত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল? আগুনের মৃত্যুগ্রাস কেন বারবার ভয়ংকর হয়ে এগিয়ে আসে? এমন প্রশ্নের কারণ বহুমুখী। এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব সহজ; কিন্তু সেসব উত্তরের গভীরতা উপলব্ধি করার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে রহস্যের কমতি নেই! ঢাকার অধিবাসীরা প্রায়ই বাইরে ঘুরতে যান, কেনাকাটা, শিক্ষা, চিকিৎসা, ভ্রমণ করে ফিরে আসেন। ফিরে এসে শুধু গালগল্প করেন। আবারও কুঠুরির মধ্যে বসতি গেড়ে কোনোরকমে থাকতে ভালোবাসেন। এক ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা না রেখে বহুতল বাড়ি তৈরি করেন। এভাবে আবাসিকতার নামে ঢাকায় গড়ে উঠেছে ইট-পাথরের স্তূপ। একজনের আটতলা বাড়ির জানালা খুললে পাশের ভবনের ১০তলার জানালার ভেতর দিয়ে সবকিছুই দেখা যায়। বাতাস খেলা করে না সেখানে। সুউচ্চ ভবন হলেও সূর্যের আলো ঢোকার সুযোগ নেই। গোপনীয়তা রক্ষায় দৃষ্টিহরণকারী রঙিন বা কালো কাচ অথবা ভারী পর্দা দিয়ে পরস্পরের জানালা ঢেকে রাখা হয়। আরেকটি বিশেষ দিক চালু হয়েছে, তা হলো কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। এটাকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী করার জন্য কক্ষের উচ্চতা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। শোলা, কাগজ, তুলা, রেক্সিন প্রভৃতি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাহারি ইন্টিরিওর ডিজাইন। সুপার মার্কেট, অফিস, এমনকি হাসপাতাল-সব জায়গায় মোটা কাচের কুঠুরি তৈরি করে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস বন্ধ করে ট্র্যাপ বা ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। অত্যাধুনিক ডেকোরেশনের নামে অভিজাত খাবারের দোকানগুলো সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। জানালা বন্ধ রেখে ইন্টিরিওর ডিজাইন করার ফলে বিদ্যুৎ চলে গেলে কিংবা জেনারেটরের তেল ফুরিয়ে গেলে গ্রাহককে গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে খাবার খেতে হয়। এ প্রবণতা শুধু ঢাকায় নয়, দেশের সব জায়গাতেই শুরু হয়েছে। এখন নাকি এটাই আধুনিক ফ্যাশন। শীতপ্রধান দেশের এসব প্রযুক্তি ও ফ্যাশন বাংলাদেশের মতো গরমের দেশে কিছুটা জৌলুস ছড়ালেও নিরাপত্তার কথাটি কেউই মাথায় রাখেন না। তাই ঢাকায় আলোর ঝলকানির আড়ালে নিরাপত্তাহীনতার চাদরের মধ্যে বসে অপেক্ষা করে মৃত্যুদূতরা। বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনে সাততলার প্রতিটিতে খাবারের দোকান ছিল। সেখানে এত স্বল্প স্থানে ১২টি রেস্তোরাঁ থাকার কথা জানা গেছে। এর আশপাশের ভবনগুলোর শুধু একটিতেই ২০টি রেস্তোরাঁ রয়েছে! বুফে খাবারের ব্যবস্থাও আছে। এজন্য শতাধিক পদ রান্নায় শতাধিক অগ্নিবোমাসদৃশ সিলিন্ডারের চুলা জ্বালানো হয়, খাবার টেবিলে জ্বলন্ত চুলায় কিছু মেন্যু সার্ভ করা হয়। সেখানে বিপুলসংখ্যক খরিদ্দারের আনাগোনা যে হয়, তা বলাই বাহুল্য। সেসব খরিদ্দারের ৫০ ভাগও যদি গাড়ি নিয়ে খেতে আসেন, তাহলে সেসব গাড়ির পার্কিং হয় কোথায়? কিছু ভবনের বেসমেন্টে কয়েকটি করে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকে। তাহলে বাকিরা নিশ্চয়ই রাস্তার মধ্যে গাড়ি রাখেন। যে কারণে বেইলি রোডে সবসময় যানবাহনের জটলা লেগেই থাকে। বাইরের বিশ্বে সুপার মার্কেট ও অভিজাত খাবারের দোকানগুলো শহর থেকে অনেক দূরে খোলামেলা জায়গায় বানানোর অনুমতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ঘরের সঙ্গে বাজার ও বাসার পাশে রেস্তোরাঁ না থাকলে চলবে কি করে? ঘরকুনো বাঙালি বিদেশে গিয়ে দেখে-শুনে দেশে ফিরলেও আদতে কিছুই শিখে আসে না, কিছুই অনুশীলন করে না। তাই তো ঢাকা শহরকে তারা দিনদিন আরও বেশি অনিয়মের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে ফেলেছে! বেশি ভাড়া পাওয়ার আশায় আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিক ভবনে রূপ দিয়ে জনগণের অসুবিধা ও বিরক্তি আরও বাড়িয়ে তুলেছেন ভবন মালিকরা। প্রশাসনের নাকের ডগায় যানজট, শব্দজট, মসলার ঝাঁজানি ও গভীর রাত অবধি খাদকদের কোলাহলে বিষিয়ে তুলেছেন আবাসিক এলাকার পরিবেশ। আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার বা পাওয়ার কোনো আইন নেই। তাদের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার কথাও নয়; কিন্তু সবকিছুই ম্যানেজড হওয়ার নিয়ম চালু হয়ে গেছে রাজধানীসহ সারা দেশে। তদবির আসে উপরওয়ালাদের কাছ থেকে। সেসব তদবির পেলে নতজানু হন আর না পেলে বেপরোয়া হয়ে যান তদারকি সংস্থাগুলোর কিছু ঘুসখোর ব্যক্তি। রাজনৈতিক লবিং ও প্রশাসনিক লাইন নেই দেখলেই তারা জুড়ে দেন নানা অন্যায় শর্ত। এসব অন্যায় শর্ত পূরণ করতে অপারগ হওয়া ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তারা তখন সরাসরি ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে আপসরফা করে নিজেদের আখের গুছিয়ে ফেলেন। বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনার পর বিভিন্ন তদারকি কর্তৃপক্ষের কিছু সৎ মানুষের মুখ থেকে ক্ষোভের সঙ্গে বলা এসব কথা গণমাধ্যমে এসেছে। প্রতিটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এর কারণ হিসাবে অবহেলা, গাফিলতি প্রভৃতি নানা বয়ান শোনাতে তারা অভ্যস্ত। সেই সঙ্গে কিছু নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করার রেওয়াজ খুবই ঘৃণিত একটি পন্থা। এতে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করা হয় মাত্র। বাপার এক নেতার মতে, এসব নিরীহ ছোটখাটো হোটেল কর্মী বা ব্যবসায়ীরা দায়ী হলেও তাদের হোতাদেরও দায়ী করতে হবে। যারা এসব বিষয় সরেজমিন তদারকি করার দায়িত্বে রয়েছেন, তারা এতদিন ধরে একটি ছোট্ট ভবনে ১২টি রেস্তোরাঁ এবং সিঁড়ির মধ্যে শত শত গ্যাস সিলিন্ডার, কেরোসিন, ডালডা-সয়াবিনের টিন রাখা দেখেও কেন সেটিকে সিলগালা করে দেয়নি-তার তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এসব ভালনেরাবল রেস্তোরাঁ ও গ্যাস, দাহ্য পদার্থ রাখা ভয়ংকর সিঁড়ির স্থানকে কেন এতদিন লাল ক্রস দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি? এখন শোনা যাচ্ছে, গ্রিন কোজি ভবনে জরুরি বহির্গমনের ব্যবস্থা না থাকায় বারবার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিন দফা নোটিশ দেওয়ার পরও মালিক যদি দোকান খোলা রেখেই থাকে, তাহলে কেন ভবনটি তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়নি? এদিকে ঘটনার পাঁচদিন পর শত শত রেস্টুরেন্টকে অবৈধ ঘোষণা করে সিলগালা করা ও ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করে দেশে হাজার হাজার নতুন বেকার বানানোর লাইসেন্স কে কাকে দিচ্ছে? ঢাকার সব রেস্টুরেন্টে হঠাৎ সিলগালা বা তালা ঝুলানোর জন্য এত তুলকালাম কাণ্ড করার পেছনে রহস্য কী? কর্মীদের বিকল্প কাজের চিন্তা না করে এত দ্রুত এসব হঠকারী ধ্বংসলীলার দায় কে নেবে? এ হঠকারিতা বেকারত্ব বাড়ানোর পাশাপাশি ঘুস-দুর্নীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে। প্রতিটি বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে, রেস্তোরাঁয়, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, একাধিক সেফ এক্সিট, ছাদের ওপরে হেলিপ্যাড স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। যে কোনো অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন। তাই এজন্য সারা পৃথিবীতে অগ্নিবিমাকে এক নম্বর প্রাধান্য দিয়ে বাধ্যতামূলক করা হয়ে থাকে। তিলোত্তমা রাজধানীর মুখে, দেহে বারবার এতবেশি অগ্নিক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে যে, এর ভয়াবহতা ও মানুষের জানমালের আর্থিক ও সামজিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য দুর্ঘটনা বিমা থাকা জরুরি। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে প্রচলিত বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো এখনো ততটা জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। তাই অগ্নিবিমাকে সরকারিভাবে বাধ্যতামূলক করতে হবে। একজন ক্ষুধার্থ মানুষ বা একটি সুখী পরিবার তার প্রিয়জনের প্রিয় দিনটি সেলিব্রেট করতে রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাবার টেবিল বসে হঠাৎ আগুন লেগেছে চিৎকার শুনে নিরাপদে সেখান থেকে বাইরের আলো বাতাসে বের হতে পারবে না, এটা কোনো ধরনের নিরাপত্তাহীনতা? কাচবন্ধ ঘরে খেতে বসে কার্বন ডাইঅক্সাইড অথবা মনোক্সাইডের প্রভাবে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে, এটা বড়ই করুণ ও মর্মান্তিক উপাখ্যান। নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বসুন্ধরা শপিংমল, এফআর টাওয়ার, নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টসে তালাবদ্ধ মৃত্যু, বঙ্গবাজার ইত্যাদি অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতস্থানের ঘা না শুকাতেই আবারও এত বড় অগ্নিমৃত্যু আমাদের শহুরে জীবনের নিরাপত্তাহীনতাকে কোথায় আবদ্ধ করে ফেলেছে, সেটি এখন দেখার সময়। দুর্নীতির ঘেরাটোপে আটকানো ঢাকার অগ্নিদুর্ঘটনায় পারস্পরিক দোষারোপের মুখোশ উন্মোচনের জন্য অনিয়মে আবদ্ধ আসল ঢাকনা সহসা খুলে দিতে আরও সৎ সাহসের প্রয়োজন। ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক fakrul@ru.ac.bd