একুশের বইমেলা মানব মিলন উৎসব


একুশের বইমেলা ‘মানব মিলন উৎসব’। এ উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা নবায়িত হই। বইমেলাকে কেন্দ্র করে আমাদের মিলনমেলা স্বজন সম্পর্কের বোধকে সজীব রাখে। মেলা থেকে আমরা কেবল বই নিয়ে ঘরে ফিরি না, ফিরি পরস্পর সাহচর্যের স্মৃতি নিয়ে, বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার উষ্ণ অনুভূতি নিয়ে, যা কিনা অর্থ দিয়ে ক্রয় করা যায় না। অস্ত্র দিয়ে পাওয়া যায় না, এমনকি স্বার্থ দিয়েও মেলে না-মেলে কেবল ভালোবাসা দিয়ে। বইমেলা থেকে আমরা ফিরি মানব সম্পর্ক নিয়ে, মানবিক অনুভূতি নিয়ে। যে কারণে বইমেলাকে আমি বলি ‘মানব মিলন উৎসব।’ একুশের বইমেলা নিয়ে এটাই আমার একান্ত নিজস্ব অনুভূতি। আমাদের পূর্বপুরুষরা লড়াই করেছিলেন একটি স্বাধীন স্বপ্নের স্বদেশভূমির জন্য। স্বপ্নের সেই স্বাধীন স্বদেশ অর্জনের লড়াই ছিল সুদীর্ঘ সময়ের। দুই শ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির সে লড়াইয়ে হাসিমুখে ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণোৎসর্গ করেছেন এ দেশের সূর্যসন্তান ক্ষুদিরাম। লড়েছেন তিতুমীর, হাজী শরীয়ত উল্লাহ, ঈশা খাঁ। লড়েছেন এ ভূমির সন্তান মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, বিনয় বাদল, দীনেশ আরও কত উজ্জ্বল প্রাণ-যারা বাংলার আকাশে দেদীপ্যমান এক একটি নক্ষত্রের সমান। সেই নক্ষত্রলোকে ১৯৫২-এর দারুণ দুঃসময়ে দুরন্ত সাহসে মায়ের ভাষার জন্য অকাতরে জীবন উৎসর্গ করে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার লিখেছেন তাদের নাম। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় আছে-‘হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থ জাগোরে ধীরে, এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে।’ মহামানবের এ সাগরতীরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমাদের একটি স্বাধীন স্বদেশভূমি দিয়ে গেছেন। আমাদের এ অর্জনের পেছনে সাহসের সূচনাবিন্দু ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির নক্ষত্রেরা। একুশের বইমেলার ‘মানব মিলন উৎসবে’ আমরা তাদের সেই আত্মত্যাগের মহত্তম দেশপ্রেম, মানবপ্রেমের সর্বজনীন সত্যকে উপলব্ধি করি, নবায়িত করি আমাদের জীবনে। ২. বাংলাদেশ একটি অহংকারের নাম। যে অহংকার অস্ত্রের, অর্থের, বিত্তের কিংবা আধিপত্যের অহংকার নয়। সে অহংকার সর্বজনীন মানবতার অহংকার। আমাদের একুশের চেতনা, আমাদের মুক্তযুদ্ধের চেতনা-সেই মানবিকতার অহংকারকেই ধারণ করে। আমাদের আরেক কবি বলেন, ‘আমরা আবহমান ধ্বংস ও নির্মাণে’-আমরা সমস্ত অশুভের বিপরীতে কল্যাণের পক্ষে। আমরা ধ্বংস চাই অমানবিকতার, নির্মাণ চাই মানবতার। একুশের বইমেলা আমাদের সেই বোধকে জাগিয়ে রাখে নিরন্তর। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-পৃথিবীব্যাপী পালিত ‘ভাষা দিবস’। পৃথিবীর সব ভাষার মানুষের অহংকার গর্ব এবং স্বাতন্ত্র্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দিন। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীব্যাপী পালিত মানব মিলনের উৎসবেরও দিন। আমাদের এ উৎসবের দিনটি একদিন ‘মানবমুক্তির উৎসব’-এর দিন হিসাবে উদ্যাপিত হবে-এটাই আমার দৃঢ়বিশ্বাস। অনুলিখন : শুচি সৈয়দ